“কেউ-ই আপনাকে অবমাননা করতে পারবে না কিন্তু আপনি ছাড়া” সাংবাদিক অ্যালান ক্লেমেন্টসের সাথে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় সাক্ষাতকারে এমনই কথা বলেছিলেন-বার্মার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নেত্রী নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অংসান সুকি। বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ইতিহাসের বর্বর, অমানবিক, নিষ্ঠুর, জঘন্য, হিংসাতœক ও লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনায় আজকে বলতে হয় অংসান সুকি ক্ষমতায় থেকে নিরিহ মুসলমানদের হত্যা করে যেন নিজেকেই অবমানননা করছেন?


মিয়ানমারের গণহত্যা এখন ‘টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। মানবতাবিরোধী এমন কর্মকা-ে বিশ্ববিবেক আজ স্তব্ধ ও হতবাক! এটি যুদ্ধাপরাধের শামিল। এ আপরাধে অং সান সুকি সরকারের বিচারের দাবী উঠছে সারা বিশ্বে। মনে করা হয় একদিন হয়তো এ গণহত্যার দায়ে অং সাং সুকিকে বিচারের কাঁঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।


এদিকে বিবিসি বিখ্যাত উপস্থাপক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিম সাংবাদিক মিশাল হুসেনের নিকট দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সুচি তার চরিত্রের অপর দিকটি উন্মোচন করেন। মুসলমানদের উপর এ অমানবিক নির্যাতনের সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলে একপর্যায়ে সুচি মেজাজ হারান এবং তাকে বিড়বিড় করে ক্রোধের সাথে বলতে শোনা যায়, ‘একজন মুসলিম যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে এটাও আমাকে কেউ বলেনি।’ মুসলিম নিধনে এমন বক্তব্যে সুকির আসল চরিত্রের খোলস উম্মোচিত হয়েছে। গত নির্বাচনে মুসলমানরা তার পক্ষে থাকলেও বরাবরই এই নেত্রীর কর্মকান্ড সন্দেহের চোখ উত্তীর্ন হতে পারেনি। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির বর্তমান অবস্থাটি যেন তার দেবীতুল্য ইমেজের সম্পূর্ণ বিপরীত। নিজেই যেন নিষ্ঠুর, অমানবিক, জঘন্য কাজটি করছে ক্ষমতায় থেকে।


এ গণহত্যা যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতকেও হার মানায়! মুসলিম নর-নারী আর শিশু-কিশোরদের আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কাঁপছে! কিন্তু ইয়াজিদের মতো মন গলছে না এ সমাজের নব্য ফেরাউন আর নমরুদের উত্তরসূরিদের। কারণ একটাই নির্যাতিত, বঞ্চিত আর অবহেলিত ওরা তো মানুষ নয়, ওরা মুসলমান! এটিই তাদের অপরাধ! এ অবস্থায় জাতিসংঘ, বিশ্বমানবাধিকার সংস্থা আর বিশ্ব মোড়লদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। মুসলিম ধর্মপরিচয়ে এই নির্যাতনের একমাত্র কারণ অন্য কিছু নয়। তা যতোভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন!


মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যার বিপরীতে সুচির সরকার কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় তার নোবেল পুরস্কার বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে চেঞ্জ ওআরজি নামের ইন্দোনেশীয়ভিত্তিক একটি সংগঠন। ইতোমধ্যে লক্ষাধিক মানুষের স্বাক্ষরে এ ধরনের আবেদন নোবেল কমিটির কাছে পৌঁছানো হয়েছে। বর্তমান সুচির সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দশকের পর দশক সে দেশের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীরা রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে আসছে।


আজ রোহিঙ্গাদের জন্য যেন কোনো আইনকানুন নেই। আইন যেন আজ নীরবে নিভৃতে কাঁদে। কারণ মুসলমানদের জন্য আইন নয়! আইন এখানে অকেজো, বিবেক এখানে ভোঁতা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব দৃশ্য আর মানুষের বোবা কান্না যেন মানব সভ্যতাকে ভাবিয়ে তুলছে! প্রতিটি রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নার আওয়াজ আমাদের আধুনিক সভ্যতার গালে এক-একটি চপেটাঘাত করে বলছে, হে আধুনিক পৃথিবীর মানবসমাজ! তুমি মুসলমানদের জন্য বড়ই অমানবিক। হে সভ্যতা! তুমি এখনও মুসলমানদের জন্য অনেক বর্বর। অথচ এই পৃথিবীতে মানবিকতা, ইনসাফ আর মজলুমের অধিকার আমরাই নিশ্চিত করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, আরাকানের নির্যাতিত, নিপীড়িত আর বঞ্চিত মুসলমানদের জন্য বিশ্বের ঘুমন্ত বিবেক জাগবে কবে?


মিয়ানমারের বুড্ডিস্ট রাখাইনদের নির্যাতন, নাসাকা ও সামরিক জান্তার অমানবিক জুলুমের শিকার রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে আর্তনাদ ও আহাজারির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। ভুক্তভোগী মুসলমানদের জীবন কাটছে মানবেতর। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ নজরদারিতে রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সেন্ট মার্টিন থেকে উখিয়ার মনখালীর ঘাট পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অস্থায়ী ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। হে! পৃথিবী তুমি মুসলমানদের জন্য আজ বড়ই নিষ্ঠুর।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের নির্যাতন নির্মমতা ইতোপূর্বেকার সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময়। নির্যাতনের ভয়াবহতা এতই ব্যাপকতর যে, রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। অনাহারে অর্ধাহারে ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে এবং মিয়ানমার সীমান্ত ছাড়িয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা। ১০ অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনীর অভিযানে প্রায় দেড় শ’ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে প্রায় অর্ধশত নারী। শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। প্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা পুরুষ ও যুবককে। যা আন্তর্জাতিক মিডিয়া, স্যোসাল মিডিয়া ও ব্লগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।


কিন্তু এ বর্বর অমানবিকতার সকল রেকর্ড ছাড়ানোর পরও বিশ্ব মোড়লদের কানে যেন তুলা আর চোখে টিনের চশমা লাগানো। মুসলিম বিশ্বও কাগজে প্রতিবাদে আবদ্ধ। জনমনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ অব্যাহত। জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও অনুরোধকে উপেক্ষাই করে চলেছে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গারা সেনা সদস্যদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পাহাড়ের পাদদেশে বা লবণের মাঠে নিজেদের ব্যবহৃত কাপড়ের তাঁবু গেড়েছে। যেসব রোহিঙ্গা পরিবার পুরনো বসতভিটা ছেড়ে যায়নি, তাদের বাড়িঘরে গিয়ে তল্লাশির নামে সেনা সদস্যরা ঘর ও দোকানের মূল্যবান মালামাল-পণ্য লুট করার পাশাপাশি গৃহপালিত গরু-ছাগল পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। গত শুক্রবার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজ আদায় করতে অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে যেতে দেয়া হয়নি।


মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর রিপোর্টে গতবছর বলা হয়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করে চলেছে মিয়ানমার সরকার। বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, ধর্ষণ, খেয়ালখুশিমতো বন্দি করা, নির্যাতন এবং প্রতিনিয়ত অসদাচরণ করা হয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। কারাবন্দিদের ওপর নির্যাতন চলে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে চরম মাত্রায়। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি। কিন্তু সেখানে তাদের কোনো সামাজিক ও সাংস্কৃতি অধিকার নেই। বিয়ে করতে গেলে আগে থেকে সরকারের অনুমতি নিতে হয়, কিন্তু অন্যদের বেলায় তা লাগে না। সন্তান ধারণের জন্য অনুমতি নেওয়ার বিধান করা হয়েছ, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। কারণ এই ব্যবস্থা মিয়ানমারের অন্য কোথাও প্রযোজ্য নয়, শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য।


কারাগার ও পুলিশ হেফাজতে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। শিশু ও নারীদের এমন সব শাস্তি দেওয়া হয়, যা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এদিকে রোহিঙ্গা বিরোধী বৌদ্ধ নাসাকা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ায় বাস্তুচ্যুত হওয়া অসংখ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও সেই নির্যাতন। ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। ফলে জীবিকা অর্জন, বাজার করা, চিকিৎসা নেওয়া কোনো অধিকারই ভোগ করতে পারে না রোহিঙ্গারা। (বিডি-প্রতিদিন ২৬ জুন ২০১৫)


মূলত খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ অব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আরাকান ছিল মুসলমানদের গড়া এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানে মগ এবং মুসলমানের মধ্যে অতীত ইতিহাসে সম্প্রীতির কোনো অভাব ছিল না। ম্রোহং (রোহাং) শহর ছিল আরাকানের রাজধানী। মহানবী (সা.)-এর জীবিতকালেই আরবদের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরব বণিকদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরবীয় দ্বীপগুলোতে মুসলমানরা আলাদা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ রাজ্যের শাসকের উপাধি ছিল ‘সুলতান’। আরাকান মূলত ইসলামী রাষ্ট্রের আদলে গড়ে ওঠা প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত একটি শহর। কিন্তু আজ নিজ মাটিতেই মুসলমানরা পরাধীন।


কথিত আছে, এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০) মুসলমানদের কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় আরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করান। আরবীয় মুসলমানরা স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে পর রহম, রহম ধ্বনি তুলে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। বলাবাহুল্য রহম একটি আরবি শব্দ যার অর্থ দয়া করা। কিন্তু জনগণ মনে করে, এরা রহম জাতীয় লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। এভাবেই আরাকানের গোড়াপত্তন।


বার্মার সঙ্গে আরাকানিদের সম্পর্ক সদাসর্বদা আরাকানিদের সর্বনাশ সাধন করেছে। বর্মীদের কাছে আরাকানিরা নিগৃহীত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে এবং স্বাধীনতার চেতনায় গর্বিত আরাকানিরা হারিয়েছে তাদের প্রিয় স্বাধীনতা। পক্ষান্তরে বাংলা-আরাকান সম্পর্ক আরাকানিদের জন্য এনে দিয়েছে স্বাধীনতা ও জাতিগত মর্যাদা। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান আরাকান উপকূলে অবস্থিত রামব্রী দ্বীপের অধিবাসী ‘থামাদা’ নামে জনৈক ব্যক্তি আরাকানের রাজধানী ‘ম্রোহং’য়ের ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করলে সুদীর্ঘকালের গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত স্বাধীন আরাকানের রাজনৈতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে পড়ে।


আরাকানি জাতি কয়েক শতাব্দী ধরে জ্ঞান-গরিমার উচ্চশিখরে আরোহণকারী মুসলিম সমাজের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে ছিল। এ সময় বর্মীরা ছিল বিচ্ছিন্ন ও পশ্চাত্পদ একটি জাতি। ভোদাপায়া আরাকান দখল করে এ স্বাধীন অবস্থার বিলুপ্তি ঘটান। অথচ ঘা-থানডির সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ছিল, ভোদাপায়া আরাকানের স্বাধীন অবস্থা অক্ষুণ্ন রাখবেন আর বিনিময়ে আরাকান বার্মার রাজাকে বার্ষিক কর প্রদান করবে যেমনটি করেছিল ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের গৌড়ের সুলতান জালালউদ্দিন শাহ। যা হোক, ভোদাপায়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে বার্মাকে একটি প্রাদেশিক রাজ্যে পরিণত করলেন এবং ঘা-থানডিকে নিয়োজিত করলেন প্রাদেশিক গভর্ণর হিসেবে।


১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্রহ্মরাজ বোধ পায়া স্বাধীন আরাকান রাজ্যে দখল করে নেয়। বর্মী সৈন্যরা আরাকানের গ্রাম গ্রামান্তরে মানুষজনকে একত্রিত করে যত সম্ভব হত্যা করে। বর্মী সেনাদের অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কে তৎকালীন আরাকানী সর্দার অ্যাপোল এর জবানীতে জানা যায়, বর্মী সেনারা নির্বিচারে ২ লাখ আরাকানীকে হত্যা করে এবং সমসংখ্যক দাস হিসেবে বার্মায় প্রেরণ করে।


স্যার হেয়াল্টার হেমিল্টনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিনি ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে রামুর শরণার্থী শিবিরে প্রায় লক্ষাধিক আরাকানী শরণার্থীর অবস্থান দেখেছিলেন। সংশ্লিষ্ট মহল উল্লেখিত ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে বলেন এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে মূলত আরাকান অঞ্চলে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে বর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একই রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও রোহিঙ্গা ও বর্মীদের মাঝে ২শ' বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব সংঘাতের ধারাবাহিকতা আজকে পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।


সুতরাং এ কথা আজ বুঝতে বাকি নেই আরাকানের মুসলমানদেরও আজকের এ দুর্দশার মূল কারণ তারা মুসলমান। আরকানের মুসলমানদের নির্যাতনের চিত্র প্রায় শত বছরের। অথচ আজ পৃথিবীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার ধর্মীয় অধিকার আর স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য বহুবিধ আইন হয়েছে। শুধু নেই মুসলমানদের জন্য!


শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বাস করে আসা জনগোষ্ঠী আজ রাষ্ট্রহীন এক জনগোষ্ঠী। বছরের পর বছর ধরে থেকে থেকে এদের ওপর নিধনযজ্ঞ চলে। রাষ্ট্রহীন হওয়ায় এরা রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত। বিশ্ববাসীর সামনেই ঘটছে এসব। বিশ্বসমাজ ও জাতিসঙ্ঘ যেন পালন করছে নীরব ভূমিকা। শুধু বিবৃতি দিয়েই যেন এরা দায়িত্ব সারছে। এই রোহিঙ্গাদের জাতিসঙ্ঘ আখ্যায়িত করেছে ‘দ্য মোস্ট পারসিকিউটেড পিপল অন দ্য আর্থ- পৃথিবীর সবচেয়ে যন্ত্রণাকিষ্ট জনগোষ্ঠী, অভিধায়। ১৪৩০ সালে বাংলার মুসলিম সুলতান ৬০ হাজার সৈন্যের বাহিনী পাঠিয়ে যদি দু’টি অভিযান চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ রাজা Narameikhtla-কে আরাকানের সিংহাসনে পুনর্বহাল না করতেন, তবে আরাকানের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতে পারত।


আরাকানিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা ভোদাপায়া আরাকান আক্রমণ করে দখল করে নিলে কয়েক হাজার আরাকানি পালিয়ে সীমান্তবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। আরাকানিরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অতর্কিত বর্মী বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। বিদ্রোহী আরাকানিদের আশ্রয়স্থল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন থাকায় বার্মার রাজা এদের মূল নেতাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্যে কোম্পানি সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। নয়তো কোম্পানির এলাকা বর্মী বাহিনী আক্রমণ করবে বলে হুশিয়ারি দেয়। একপর্যায়ে ধূর্ত ব্রিটিশ ছল-চাতুরীর সাহায্যে তিনজন বিদ্রোহী বন্দির চোখ উপড়ে ফেলে এবং জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত নিক্ষেপ করে মেরে ফেলে। ব্রিটিশদের এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ নিষ্ঠুর আচরণকে গোটা ভারত বর্বরতা বলে অভিহিত করে। এত অত্যধিক সংখ্যক আরাকানি পালিয়ে আসে যে, এ অঞ্চলে এক মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। শুধু দৈনিক শিশুর মৃত্যুর হার বিশ জন বলে এক রিপোর্টে উল্লেখ আছে। নাফ নদী আরাকানিদের মৃত দেহে ভরে ওঠে। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের বৌদ্ধদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিতে থাকে। সুদীর্ঘকাল ধরে পাশবিক বর্বরতায় অভ্যস্ত জলদস্যুরা আরাকান পৌঁছলে আরাকান নানা ধরনের অপকর্মে ভরে ওঠে। বর্বরতা ও পাশবিকতায় আরাকানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়ে।


ঐতিহাসিক সিহাবদ্দিন তালিশ মগ দস্যুদের দস্যুবৃত্তির স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, মগ দস্যুরা জলপথে নদীর মোহনা থেকে বঙ্গদেশের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জনপদগুলোতে অতর্কিত হামলা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। স্ত্রী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ ধনী দরিদ্র যাকেই পেত অমানুষিক অত্যাচারের পর বন্দি করে নিত। বন্দিদের হাতের তালু জ্বলন্ত লৌহ শলাকা দিয়ে ছিদ্র করে ছিদ্রপথে সরু বেত চালিয়ে বেঁধে টানতে টানতে জাহাজের নিম্নতলে নিক্ষেপ করে বস্তার মতো স্তুপ করে রাখতো। সকাল-সন্ধ্যা জাহাজের উপর থেকে ছিদ্রপথে খাদ্যস্বরূপ আস্ত চাল নিক্ষেপ করত। এত পাশবিক অত্যাচারের পরও যারা বেঁচে যেত, তাদেরই তারা আরাকানে নিয়ে যেত। আরাকান রাজ এদের পতিত জমি আবাদ করে কৃষিকাজে নিয়োগ করত।


আরাকানের নৃশংসতম গণহত্যা : ১৯৪২ সালের জুন মাসে আরাকানের মগ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে প্রভৃতি এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বেপরোয়া গণহত্যার সূচনা করে। নারী শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে হত্যা, লুটতরাজ ও গ্রামের পর গ্রাম বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েও উন্মত্ত মগ হামলাকারীরা ক্ষান্ত হয়নি, বহু মানুষের মস্তক বর্শার মাথায় বিঁধে তা-ব নৃত্য করেছিল। আকিয়াবের মরহুম খলিলুর রহমান বিএ. বিএল তার কারবালা-ই-আরাকান গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ১৯৪২ সালের গণহত্যায় সম্পূর্ণ উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ৩৭৬টি গ্রামের বর্ণনা দিয়ে বার্মার পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। উন্মত্ত মগ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য দুর্গম আপক গিরিপথে যাওয়ার সময় হাজার হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেন। কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন সমুদ্রের উপকূলবর্তী একটি এলাকায় বহু উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসন করেছিলেন, যা এখনও রিফিউজি ঘোনা নামে পরিচিত। দুঃখজনক বিষয় হলো, বার্মা সরকার এসব উদ্বাস্তুকে আর স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়নি।


বর্তমান সময়ে নির্যাতনের নিষ্ঠুর, পৈশাচিক ও রোমহর্ষক ঘটনা তো সবারই জানা, যা প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। আরাকানের গোটা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলমান রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। তাদের কেউ হাজার বছর, কেউ পাঁচ শতাধিক বছর আর কেউবা কয়েকশ’ বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। স্থানীয় মগ জনগোষ্ঠী এবং প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তায় আরাকানের মংডু এবং আকিয়াব এলাকায় চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বিরানভূমিতে পরিণত করছে গ্রামের পর গ্রাম। রোহিঙ্গা তরুণীদের অপহরণ করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। ইতোমধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি তরুণীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। খাল, বিল ও জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মহিলাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সেখানে। তাছাড়া অনেক মুসলমানকে হত্যার পর লাশ গুম করছে। অনেককে হত্যা করে বৌদ্ধদের গেরুয়া কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে মিডিয়ায় বৌদ্ধ বলে চালিয়ে দিচ্ছে।


খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপে ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেমন ১৬৪৮ সালের Peace of Wesphalia জার্মানিতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের সমান অধিকারকে স্বীকার করে নেয় এবং এতে করে তাদের মধ্যে ৩০ বছরের যুদ্ধের অবসান হয়। ১৭৬৩ সালে ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন এবং পর্তুগালের মধ্যে সম্পাদিত ‘প্যারিস চুক্তি’ (Treaty of Paris, ১৭৬৩) অনুযায়ী গ্রেট ব্রিটেন তার সদ্যপ্রাপ্ত কানাডিয়ান ক্যাথলিকদের ততটুকু ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ দেয়।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৮ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক মানুষের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা হয়েছে। যে নাগরিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে এবং ভীতি ও অভাব থেকে মুক্ত থাকে, কেবল তখনই অর্জন করা সম্ভব, যখন সেই অবস্থা সৃষ্টি করা হয় যেখানে প্রত্যেকেই তার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার উপভোগ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এসব আইন থাকলেও তা আজ মুসলমানদের জন্য তা যেন একেবারেই প্রযোজ্য নয়! কিতাবে লেখা এ আইনে আরাকানের মুসলমানদের বেচে সামান্য সুরক্ষাটুকু কি দিতে র্ব্যথ বিশ্ববাসী? কবে ফিরে পাবে আরাকানের মুসলমানরা তাদের হারানো স্বাধীনতা?