১. ভূমিকাঃ 

মানুষ ‘‘আশরাফুল মাখলুকাত’’, সৃষ্টির সেরা জীব। আর এই সেরা বা শ্রেষ্ঠত্ব জন্মগত নয় বরং তা অর্জন করতে হয় যা শিক্ষার মাধ্যমেই সাধিত হয়। শিক্ষা এমন এক প্রণালী যা মানুষের অন্তর্নিহিত জ্ঞান প্রতিভাকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মনুষ্যত্ববোধ উজ্জীবিত করে নৈতিকতার চোখে বিশ্বকে দেখায়। ফলস্বরূপ সে সহজে ভাল মন্দ উপলব্ধি করতে পারে যা তাকে গুনাহের পথ থেকে বাঁচিয়ে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। মোটকথা শিক্ষা মানুষের পাহারাদার যেমন মানুষ তার সম্পদের পাহারাদার। শিক্ষা মানুষের জ্ঞানের ক্ষুধাকে নিবৃত করে অন্তরে পবিত্রতা দান করে। শিক্ষার মূলত কোন বয়স নেই মানুষ জন্মপরবর্তী শিশুকাল থেকে মৃত্যুপূর্ব বার্ধক্যকাল পর্যন্ত শেখে। জ্ঞান শিক্ষার বেশ কিছু প্রকার আছে, যেমন কিছু জ্ঞান মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচার তাগিদে শেখে, এক্ষেত্রে প্রস্তর যুগের সভ্যতার কথা বলা যায়, আবার কিছু জ্ঞান জীবনকে সুন্দর, সময়কে সংক্ষেপ ও যাতায়াতকে করে সহজ, আবার কিছু জ্ঞান মানুষের চিন্তার জগতকে প্রসারিত করে, ঈমানকে মজবুত করে অন্তরকে নৈতিকতার আলোকে জীবন্ত করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শিক্ষা একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া যা মানুষের বস্ত্তগত প্রয়োজনের সাথে আত্মিক উন্নতি সাধনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই জাতির নতুন প্রজন্মকে ভবিষ্যতের সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানের জন্য একটি যুগোপযোগী নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষানীতি প্রণোয়নের কোন বিকল্প নেই।
২. শিক্ষার সংজ্ঞাঃ
বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ (In Broad Sense) থেকে বিচার করলে প্রতীয়মান হয় যে, শিক্ষা একটি কর্ম বা অভিজ্ঞতা যাতে ব্যক্তির মন, চরিত্র ও শারীরিক ক্ষমতার একটি দিক নির্দেশনামূলক প্রতিফলন থাকে। প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজ ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে এর সঞ্চিত জ্ঞান, যোগ্যতা ও মূল্যবোধ এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তর করে। শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী ইংরেজী ভাষার Education শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Educare থেকে এসেছে যার অর্থ Bring up যা ল্যাটিন শব্দ Educere-এর সাথে সম্পর্কিত যার অর্থ Bring out বা Bring forth what is within বা Bring out potential এবং ল্যাটিন শব্দ Ducere-এর সাথে সম্পর্কিত যার অর্থ To lead. বাংলা ভাষার শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত ‘সাস’ ধাতু থেকে। সাধারণভাবে বলা যায় মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা। যুগে যুগে নানা মনীষী শিক্ষাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আবার সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার সংজ্ঞা বা ধারণায়ও পরিবর্তন এসেছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক, ভাষাসৈনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক গোলাম আযম (জন্মঃ ০৭ নভেম্বর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘প্রয়োজনীয় গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ব্যবস্থার নামই শিক্ষা’। কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল (০৯ নভেম্বর, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ - ২১ এপ্রিল, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ) বলেছেন, ‘মানুষের খুদির বা রূহের উন্নয়নই আসল শিক্ষা’। বিশিষ্ট গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ অব্দ - ৩৯৯ অব্দ) শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘নিজেকে জানার নামই শিক্ষা।’ হারম্যান হর্ন (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ - ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে মুক্ত সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সাথে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া, যেমনটি প্রমাণিত রয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশ’।
শিক্ষার ইতিহাস খুঁজতে হলে আমাদের পৃথিবীর প্রথম মানুষটির কাছে যেতে হবে। নবী আদম (আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হচ্ছেন মানবজাতির প্রথম ও আদি শিক্ষাগুরু। আর তিনি যে উৎস থেকে জ্ঞান লাভ করেন তা হচ্ছে ওহি। তারপর দীর্ঘ পথপরিক্রমা। মানুষ যখনই ওহির শিক্ষা ভুলে অশিক্ষার অন্ধকার তথা জাহিলিয়াতে লিপ্ত হয়েছে, তখনই আবার ওহির জ্ঞান দিয়ে আল্লাহ্ কোন নবী বা রাসূলকে পাঠিয়েছেন কোন নির্দিষ্ট কাওমকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এভাবে যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল এসেছেন অধপতিত মানব জাতিকে সঠিক পথের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এ ধারায় সর্বশেষে আইয়্যামে জাহিলিয়াতের অমানিশার ঘোর অন্ধকার ভেদ করে জন্ম নিলেন জগতের শ্রেষ্ঠতম মানুষ, বিশ্বের আলোকবর্তিকা, সমগ্র পৃথিবীর রাহমাত, রাহমাতুল্লিল ‘আলামিন, মানবজাতির মহান শিক্ষক শ্রেষ্ঠ দার্শনিক নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের কাছে তাই শিক্ষকগণ উঁচু মর্যাদার অধিকারী। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর শিক্ষার্থীদের মন-মগজে একথা বদ্ধমূল করার চেষ্টা করেছেন যে, শিক্ষকই হলেন সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। তাঁরা মানব জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে আল্লাহ্ ও সৃষ্টিকুলের শিক্ষকের মর্যাদা অত্যুচ্চে। তাই সৃষ্টিকুল শিক্ষকমন্ডলীর জন্য আল্লাহ্র নিকট দু‘আ ও ইসতিগফার করে। তিনি সাহাবীদেরকে বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিবাসীগণ, এমনকি গর্তে অবস্থানরত পিঁপড়া এবং মাছ পর্যন্ত মানুষকে সৎ ও কল্যাণের কথা শিক্ষাদানকরীদের জন্য অবশ্যই দু‘আ ও ইসতিগফার করে। মানবজাতির সর্বাধিক ও সর্ববিভাগের শ্রেষ্ঠ মডেল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। সত্য সুন্দর, মঙ্গল ও কল্যণের শিক্ষক মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এত জ্ঞান দান করেন যে, মানব জাতির মধ্যে অন্য কাউকে তা দান করেননি। একটি ব্যক্তি সত্তাকে যে সকল গুণ-বৈশিষ্ট্য অনন্য ও অতুলনীয় করে তোলে তার সবই তাঁকে পরিপূর্ণরূপে দান করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কৃত অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ
وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا-
‘‘তুমি যা জানতে না তিনি তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। তোমার প্রতি আল্লাহ্র মহা অনুগ্রহ রয়েছে।’’ (সূরা আন নিসা, আয়াতঃ ১১৩)
বর্ণনার সৌন্দর্যে, ভাষার প্রাঞ্জলতায়, কথার স্পষ্টতায়, নিয়ম পদ্ধতির মাধুর্যে, ইশারা ইঙ্গিতের চমৎকারিত্বে, প্রাণের আলোকচ্ছাঁয়, অন্তরের কোমলতায়, বক্ষের প্রশস্ততায়, দয়া-মমতার প্রাচুর্যে, কঠোরতার বিজ্ঞতায়, সতর্কতার মহানুভবতায়, মেধার প্রখরতায়, যত্ন-তত্ত্বাবধানের পরিপক্কতায় এবং মানুষকে সঙ্গদানের পর্যাপ্ততায় তিনি ছিলেন এই পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে প্রথম শ্রেষ্ঠ কল্যাণকর শিক্ষক। আর এ কারণে তিনি বলতেন, ‘‘আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি।’’ তাঁর উপর যে ওহি আসত, আমাদের যা শিক্ষণীয় তা হলো মুসলিম মিল্লাতকে শত ভাগ শিক্ষিত হতে হবে। আল্লাহর কালাম এবং হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে শিক্ষার যে গুরুত্ব তাকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। অথচ মুসলিম শাসকরা এ বিষয়ে যথার্থ গুরুত্ব দিচ্ছেন কি? ‘সাঈদ ইবন্ ‘উফায়র (রাদিআল্লাহ্ আনহু).......হুমায়দ ইবন্ ‘আবদুর রহমান (রাদিআল্লাহ্ আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি মু‘আবিয়া (রাদিআল্লাহ্ আনহু)-কে বক্তৃতারত অবস্থায় বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ্ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের জ্ঞান দান করেন। আমি তো কেবল বিতরণকারী, আল্লাহই দানকারী। সর্বদাই এ উম্মাত কিয়ামাত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
বর্তমান বিশ্বে কর্তৃত্বের যে লড়াই তার মূল হচ্ছে ইলম বা জ্ঞান। আমরা তাকে যেভাবেই দেখি না কেন, এ লড়াই হচ্ছে মূলত জ্ঞানের লড়াই। আমাদের সর্বদিকে জ্ঞানী হতে হবে। আর এ শিক্ষা আমরা প্রত্যেক নবী ও রাসূলের কাছ থেকে পাই। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, প্রত্যেক নবী-রাসূলকে সমসাময়িক কালে সব বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ করে পাঠানো হয়েছে। আর আমরা মুসলিম মিল্লাত সমকালীন বিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে কত যে পিছিয়ে আছি তা আমাদের বর্তমান অবস্থাই বলে দেয়। এ দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘ভিখারীর বেশে খলিফা যাদের/শাসন করিল আধা জাহান, তারা আজ পড়ে ঘুমায় বেহুঁশ/বাইরে বইছে ঝড়-তুফান।’
৩. শিক্ষার উদ্দেশ্য পর্যালোচনা ঃ
আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে অনেক শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ মন্তব্য পেশ করেছেন। তাদের মধ্যে আল্লামা ইকবাল (০৯ নভেম্বর, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ, ২১ এপ্রিল, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ) বলেছেন ‘পূর্ণাঙ্গ মুসলিম তৈরি করাই হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য।’ অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ কুতুব (জন্মঃ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) Concept of Islamic Education প্রবন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন, যার সারমর্ম আমরা এভাবে উল্লেখ করতে পারি ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানসিক উৎকর্ষ সাধন’। গ্রিক দার্শনিক প্লোটোর (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দ-৩৪৭ অব্দ) মতে, ‘শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।’ গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দ-৩২২ অব্দ) বলেছেন, ‘শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।’ মহাকবি জন মিল্টন (০৯ ডিসেম্বর, ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ-০৮ নভেম্বর, ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দ) শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নতি সাধন।’ এভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যত মতামত এসেছে সব কথার মূল হচ্ছে নৈতিক আচরণ, আত্মপরিচয় ও দায়িত্বানুভূতি বিকাশে সাহায্য করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হল ‘যোগ্য নাগরিক’ সৃষ্টি করা, যদিও নাগরিক ও তার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ও অভিন্ন কোন সংজ্ঞা নেই। কেননা, বিভিন্ন জাতির নিকট এর বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। কোন দেশে এর অর্থ হল অন্যায় ও বিদ্রোহ দমন করা কিংবা বিদ্রোহ দমনে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করা অথবা সে এমন একজন ভাল লোক যে অন্যায় ও বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না, কোন সময় সে আবেদ হয় যে পার্থিব জগত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে, কোন সময় সে দেশপ্রেমিক হয় ও নিজস্ব বর্ণ রক্ষার জন্য উন্মাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এতদসত্ত্বেও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এরা সবাই দেশের যোগ্য নাগরিক। ইসলাম নিজেকে এহেন সংকীর্ণতার মধ্যে নিক্ষেপ করেনি। ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য নাগরিক নয় বরং ‘যোগ্য মানুষ’ গড়ার ব্যাপক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। মানুষ শব্দটি ব্যাপক মনুষত্ব ‘অর্থবোধক’। এই অর্থে মানুষ শুধু নির্দিষ্ট কোন ভূ-খন্ডের নাগরিকই নয়, এরও ঊর্ধ্বে উঠে সে হচ্ছে কেবল ‘মানুষই’। ইসলামের এই শিক্ষা মানুষের জ্ঞান, আত্মা, বৈষয়িক ও নৈতিক সর্বদিক ব্যাপৃত। ইসলাম মানুষকে শরীর জ্ঞান ও আত্মার সমন্বিত এক পূর্ণ অবয়ব মনে করে। এগুলোসহ তাদের বৈষয়িক ও নৈতিক যাবতীয় কাজের সর্বাত্মক উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন করাই হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য।
মানুষ কেবল চোখ দিয়েই দেখেনা, এর পেছনে রয়েছে তার সক্রিয় মন ও মগজ। রয়েছে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত। জীবনের একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে তার। সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার একটা প্রক্রিয়া তার আছে। মানুষ যা কিছু দেখে, শুনে এবং জানে, সেটাকে সে নিজের মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীল করে নেয় এবং সেই চিন্তা ও ধ্যান ধারণার ভিত্তিতেই তার জীবন পদ্ধতি গড়ে উঠে। এই জীবন পদ্ধতিই হলো সংস্কৃতি। যে জাতি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যের অধিকারী এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব জীবনাদর্শ, তাদেরকে অবশ্যই তাদের নতুন প্রজন্মকে সেই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও জীবনাদর্শের রক্ষাণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ ও উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। আর সে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলতে হবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে চিন্তাশীলতার ক্ষমতা অর্জন করা যাতে সে সত্য-মিথ্যার ব্যবধান উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ‘এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নিজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্য যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মতো সমালোচনার যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে।
৪. মানব জীবনে শিক্ষার গুরুত্বঃ
পশু সমাজে শিক্ষার কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রচলন দেখা যায় না। একটি ছাগল-ছানা কিংবা একটি ছোট্ট বাছুরকে খাবার সংগ্রহ বা জীবন-পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া এবং তাদের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য বিকাশের জন্য পশুসমাজে শিক্ষা আদান-প্রদানের কোন ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই না। তার কোন প্রয়োজনও নেই; কারণ জন্মগত ভাবেই তারা পশুত্বের স্বভাব পেয়ে থাকে এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের পশুত্বের বিকাশ হয়। মানুষের স্বভাবের মধ্যেও একটি পাশবিক সত্তা রয়েছে এবং মানব-প্রকৃতির এই পাশবিক সত্তার বিকাশও অন্যান্য পশু-পাখি ও জীব-জানোয়ারের মতই প্রাকৃতিক নিয়মে আপনা-আপনি হয়ে থাকে। পশু প্রবৃত্তি অর্জন করার জন্য কাউকেই কোন কষ্ট করতে হয় না। পশুত্ব বিনা পরিশ্রমেই অর্জন করা যায়। কিন্তু মানুষ কোন পশুর নাম নয়।’ ‘শুধুমাত্র মানুষেরই জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন। অন্যান্য প্রাণীকূল পরিবেশ থেকেই তাদের সহজাত জীবন পদ্ধতি ও নিয়মাবলী পর্যাপ্তভাবে জানতে পারে, যা তাদের স্রষ্টা তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তারা কখনই ভুল জ্ঞান বা অজ্ঞতার ফলস্বরূপ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।’ ‘অন্যান্য জীব-জানোয়ার ও পশু-পাখির তুলনায় সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। বলাবাহুল্য সৃষ্টি জগতের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হল তার মনুষ্যত্বের কারণে। আর মানবশিশুকে এই মনুষ্যত্ব রীতিমত অর্জন করতে হয়। মনুষ্যত্ব হচ্ছে মানব-প্রকৃতিতে সুপ্তাবস্থায় বিদ্যমান মৌলিক মানবীয় ও সৎ গুণাবলী, তার বিবেকবোধ ও জীবনবোধ এবং সুকুমার বৃত্তি ও সৃজনশীলতা। এসবের যথার্থ বিকাশের উপরই মানব সন্তানের মনুষ্যত্ব অর্জন নির্ভর করে। মানব সন্তানকে তার জীবিকা অর্জন বা রুটি-রুজির জন্যও ব্যাপক কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। একজন মানুষ তার জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন্ ধরণের পেশাকে বেছে নিবে তা তার জীবনের কৈশোর কাল থেকেই নির্ধারণ করে নিতে হয় এবং সে অনুযায়ীই তাকে পড়াশোনা ও অধ্যয়ন করতে হয় এবং হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।’ জ্ঞানসাধনাই সৃষ্টিলোকে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। বস্ত্ততান্ত্রিক প্রয়োজনের সাথে সাথে মানুষের আত্মিক উন্নয়নের জন্যও জ্ঞান শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ‘মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ইলম তালাশ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। এখানে ইলম অর্থ যদি সব বিদ্যাই হয় তবে কেউ এই ফরয আদায় করতে পারবে না। ডাক্তারি বিদ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা, কৃষি বিদ্যা ইত্যাদি শেখা সবার উপর ফরয হতে পারে না। তাই এই হাদীসে যে ইলম হাসিলের কথা বলা হয়েছে তা অবশ্যই ওহির ইলম।’ একথা অবশ্যই মানতে হবে যে সকল জ্ঞানের মূলেই আছে ওহির জ্ঞান বা ইলম অর্থাৎ জীবিকার জন্য মানুষ যে সমস্ত বিদ্যা শিক্ষা করে তার সবকিছুর মূলেই আছে ওহির জ্ঞান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে হালাল রুজী তালাশ করার জন্য আমরা যে বিদ্যা শিক্ষা করি তাও পরোক্ষভাবে ফরয। ‘সুতরাং দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হল শিক্ষা। তাই প্রতিটি দেশেই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে শিক্ষাকে।’
৫. শিক্ষার ধরণঃ
শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষ জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত শেখে। তাই শিক্ষা লাভের ধরণ বিভিন্ন। শিক্ষার ধরণ মূলতঃ তিনটিঃ
(ক) আনুষ্ঠানিক শিক্ষা
(খ) অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও
(গ) উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা।
(ক) আনুষ্ঠানিক শিক্ষাঃ
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ধারাবাহিক এবং ক্রম উচ্চস্তরে বিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝানো হয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকে। শিক্ষার্থী একটি বয়সে আনুষ্ঠানিক উপায়ে শিক্ষা অর্জন শুরু করে এবং ধারাবাহিকভাবে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকে।
(খ) অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাঃ
অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য ধরণ। মানুষ তার জন্মের পর থেকে এটি নানাভাবে শিখছে। এই শিক্ষা তার সমাজের কাছ থেকে হচ্ছে, পরিবারের কাছ থেকে হচেছ, আবার গুরুজনের কাছ থেকে কিংবা বিশিষ্ট বা সাধারণ ব্যক্তির কাছ থেকে এবং বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমেও হচ্ছে। আবার প্রকৃতির কাছ থেকেও মানুষ শিখছে। প্রতিনিয়ত তার শিক্ষার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে শিখে। এই যে অনির্দিষ্ট নানা উপায়ে মানুষ শিখছে এটাই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাই আমাদের শিক্ষার বা আচার-আচরণের অনেক বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দেয়। জন্মের পর একটি শিশুর কিভাবে কথা বলতে হবে তাকে আলাদা করে শিখাতে হয় না, সে নিজে নিজে তার পরিবারের সবাইকে দেখেই শিখে। এইভাবেই সূচনা হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার। প্রাচীন সমাজে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল শিক্ষা লাভের একমাত্র উপায় এবং এ শিক্ষা ছিল সর্বজনীন। বাঁচার জন্য এবং বাঁচার মধ্যে দিয়ে এ শিক্ষা অর্জিত হতো। তখন সামাজিকীকরণ ও শিক্ষার মধ্যে কোন প্রভেদ ছিল না। আধুনিক সমাজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আধিপত্য সত্ত্বেও পারিবারিক শিক্ষাই এখনো শিশুর মানসিক বিকাশ ও চরিত্র গঠনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
(গ) উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাঃ
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষার একটি অন্যতম ধরণ। মূলত: উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে এই ধারার উৎপত্তি। সাধারণত: আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতি বা প্রতিষ্ঠানের বাইরে সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে সংগঠিত এবং বিশেষ শিখন চাহিদা পূরণের জন্য আলাদাভাবে বা সমন্বিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত শিক্ষামূলক কার্যক্রমই হচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Non formal education)।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারণা নতুন নয়। উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে (drop out) বা কোন না কোন কারণে প্রাথমিক শিক্ষাচক্র (Primary Education Cycle) সমাপ্ত করার আগেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। ফলে এইসব দেশে এইভাবে নিরক্ষর জনগণের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তাই তাদের মাঝে এইসব দেশের বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত সুবিধাবঞ্চিত (Disadvantaged) ছেলে-মেয়ে, কিশোর-কিশোরী এবং বয়ষ্ক লোকদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ (Second Chance of Education) প্রদান করা যায়। তাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ দানকারী কার্যক্রমও বলা হয়।
আবার উন্নয়নশীল দেশসমূহে দেখা যায় সরকারের একার পক্ষে সকল শ্রেণীর সকল মানুষের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই সেসব ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সহায়ক/সম্পুরক ও পরিপূরক (Supplementary and Complementary) হিসেবেও কাজ করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে কখনই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে না।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্যঃ
১. এটি একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম-কানুন ও পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত উন্মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা।
২. শিক্ষাক্রম নির্দিষ্ট নয়, আর থাকলেও শিথিলযোগ্য।
৩. ডিগ্রীমুখী বা সার্টিফিকেটমুখী শিক্ষা নয়।
৪. এটি স্থানীয় সুযোগ সুবিধা ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম।
৫. শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুসারে বিষয়বস্ত্ত নির্ধারিত হয়।
৬. ব্যবহারিক দিকগুলোর প্রতি বেশি লক্ষ্য রাখা হয়।
৭. আলাদাভাবে পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যবস্থা নেই তবে ধারাবাহিক মূল্যায়ণের ব্যবস্থা আছে।
৬. প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন প্রচেষ্টার ইতিহাসঃ
ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন পূর্বকালে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল তা ছিল সে সময়ের সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বৃটিশ আগমনের পর এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে নতুন সাজে সাজাবার তারা নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ১৭৫৭ সাল হতে ঐ শতাব্দীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ইংরেজগণ ভারতবাসীদের শিক্ষার জন্য আদৌ মাথা ঘামাননি। ১৭৯২ সালে সর্বপ্রথম মিষ্টার অলিভার ভারতবাসীদের শিক্ষার জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টে এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অবশেষে ১৮১৩ সালে ভারতবাসীদের শিক্ষা সম্পর্কে বিবেচনা ও সুপারিশ করার জন্য এক শিক্ষা কমিটি নিয়োজিত হয়। ১৮১৪ সালে কমিটির সুপারিশ অনুসারে ভারতবাসীদের শিক্ষার জন্য বড় লাটের নামে এক আদেশ জারি করা হয়। ১৮২৩ সালে গঠিত হয় শিক্ষা কমিটি। এই কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু কলেজগুলোকে উৎসাহ দানের প্রতি লক্ষ্য রাখা। উক্ত কমিটির মাধ্যমে এদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় তা ছিল মুসলিমদের জন্য প্রতিকূল, নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় মুসলিম ছাত্রদের জন্য ধর্ম সম্পর্কীয় প্রাথমিক জ্ঞান লাভের কোন ব্যবস্থা ছিল না। তা ছিল মুসলিমদের পক্ষে একটা অসহনীয় ব্যাপার। এই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল শুধু পার্থিব স্বার্থের উপর ভিত্তি করে রচিত।
এরপর পুনরায় ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই পরিষদের নিয়মাবলী ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে কোন মনীষার বাহনরূপে নয়, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বের সর্বময় প্রকাশ-মাধ্যমরূপে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষা গভীরভাবে জীবনের সাথে গ্রথিত হোক এবং তা ছড়িয়ে যাক সর্বস্তরে। লোক শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে যে এদেশের আর্থসামাজিক বিবিধ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব এ বিশ্বাসে তিনি ছিলেন দৃঢ়মূল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (০৭ মে, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-০৭ আগস্ট, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ) নেতৃত্বে শিক্ষা কারিকুলামে তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। পরবর্তীতে শিক্ষাব্যবস্থার উপরে মহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (০২ নভেম্বর, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ-৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ) নেতৃত্বে গ্রহণ করা হয় বরদা পরিকল্পনা। এ গোটা পরিকল্পনা যে মৌলিক আদর্শ ও নীতিমালার ভিত্তিতে রচিত তার প্রধান দিকটি ছিল জাতির শিশুদের ভালো ব্যবসায়িক যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের দৃষ্টিতে মনুষ্যত্ব ও উপার্জনের যোগ্যতা সমার্থক শব্দ। বস্ত্তবাদী ও ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমগ্র পরিকল্পনাটিকে এমনভাবে প্রভাবিত করে রেখেছে যে, এর মাধ্যমে যে বংশধর শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করবে, তারা নিরেট বস্ত্তবাদী হয়ে গড়ে উঠবে। বরদা শিক্ষা পরিকল্পনা থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়। বাদ দেয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে মহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) বলেন: ‘‘আমরা বরদা শিক্ষা পরিকল্পনা থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দিয়েছি; কেননা, আজকাল ধর্মীয় শিক্ষা যেভাবে দেয়া হয় এবং যেভাবে তার বাস্তব অনুশীলন হয়ে থাকে, তাতে ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদ সৃষ্টি হয়।’’ সকল ধর্মকে বাদ দিয়ে মহত্মাগান্ধীর ধর্মের শিক্ষা পাঠ্য তালিকাভূক্ত করা হয়। কারণ, এরপর যে বংশধর ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত হয়ে বের হবে, তাদের নৈতিক মত, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার উৎস হবে একমাত্র গান্ধীর ধর্ম। এর ফলে পরবর্তী বংশধর, যারা বরদা পরিকল্পনাভূক্ত বিদ্যালয় সমূহ থেকে শিক্ষা লাভ করে বেরিয়ে আসবে, তাদের উপর বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন ভারতীয় জাতীয়তার ধারণা এত প্রবল হবে যে, তারা আপন সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার তেমন ধার ধারবে না। সুতরাং এটা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া উচিৎ যে, তৃতীয় বংশধর পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভারত সত্যিকার অর্থে এক জাতিতে পরিণত হয়ে যাবে।
একই সময় মধ্য প্রদেশে অন্য একটি শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, যা ছিল বিদ্যামন্দির পরিকল্পনা নামে খ্যাত। এর প্রণেতা ছিলেন প্রাদেশিক মূখ্যমন্ত্রী মিষ্টার শুকলা। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৭ সালের ৩০শে জুলাই মিষ্টার শুকলাকে সভাপতি করে পল্লী অঞ্চলে বাধ্যতামূলক সর্বজনীন শিক্ষা চালু করার উপযোগী পরিকল্পনা তৈরি করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করে। মধ্যপ্রদেশ বিধান সভায় কংগ্রেস সংসদীয় দল ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে পরিকল্পনাটির মঞ্জুরি দেয়। পরিকল্পনাকে মঞ্জুর করার পর যে সিলেবাস পরিষদ গঠিত হয়, মধ্য প্রদেশের একজন মুসলিমকেও তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। টেক্সটবুক কমিটিতেও একজন মুসলিম রাখা হয়নি। ফলে মধ্যপ্রদেশের শাসনাধীন মুসলিমদের আপন ভবিষ্যৎ বংশধরদের শিক্ষার ব্যাপারে কিছুই বলার স্বাধীনতা রইল না। বরোদার বিদ্যামন্দিরগুলোর জন্য শিক্ষক তৈরির ব্যবস্থা নিতে একটা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করা হয়। উক্ত স্কুলে মুসলিমদের অবস্থা ছিল বড়ই করুন। মধ্য প্রদেশের বিধান সভার সদস্য মৌলভী আবদুর রহমান সাহেব উক্ত ট্রেনিং স্কুল পরিদর্শনে গেলে দেখতে পান হিন্দু ও মুসলিম সকলেই ধূতি পরা। সেখানে সকল পাঠ্য বিষয় হিন্দী ও মারাঠী ভাষায় পড়ানো হয়। কেবলমাত্র উর্দূ বর্ণমালা শিখানোর জন্য একজন মুসলিমকে নিয়োগ করা হয়েছে। মুসলিম ছাত্ররা সেখানে অস্পৃশ্যদের মত থাকে, তারা আলাদা খাওয়া দাওয়া করে। পানি খাবার পাত্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। প্রতিদিন বন্দে মাতরম সঙ্গীত দিয়ে স্কুল শুরু হয়। মুসলিম ছাত্রদেরকে প্রার্থনার ভংগীতে হাত জোড় করে ও মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়।
এ দুইটি শিক্ষানীতিই ছিল মুসলিমদের বিপক্ষে। বরদা পরিকল্পনা ও বিদ্যামন্দির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মুসলিমদের পক্ষ থেকে যেসব আপত্তি তোলা হয়েছে তার জবাবে অন্যান্য কথার সাথে সাথে একথাটিও বরাবর বলা হচ্ছে যে, যে দেশে বহুসংখ্যক ধর্মের অনুসারীরা বাস করে সেখানে সকলের ধর্মের শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এরূপ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কেবলমাত্র সাধারণ বৈষয়িক শিক্ষার ব্যবস্থাই করা যেতে পারে। আর সর্বজনীন শিক্ষা চালুর জন্য ব্যাপক ভিত্তিক বাধ্যতামূলক ও ধর্মহীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা ছাড়া অন্য কোন কৌশল অবলম্বন করার থাকে না। অথচ ইউরোপের যেসব সুসভ্য দেশে ধর্মের কোনই গুরুত্ব নেই, সেসব দেশের মধ্যে ফ্রান্সসহ অন্যান্য দু’চারটা দেশ ছাড়া কোন দেশই ভারতের মত নীতি অবলম্বন করেনি। যেমন ইংল্যান্ডে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আপন উদ্যোগে নিজস্ব বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনায় অধিকার রয়েছে। সরকারী শিক্ষা বিভাগ শুধু তার তদারক করে থাকে এমনকি এ ধরনের বিদ্যালয়কে সরকার সাহায্যও দিয়ে থাকে। লিথুনিয়ার সরকারী বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। কেবলমাত্র যেসব ছেলেমেয়ের পিতামাতা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে ইচ্ছুক নয় তারাই এর ব্যতিক্রম। তাছাড়া সেখানেও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে আপন বিদ্যালয় স্থাপনের অধিকার রয়েছে এবং সরকার তাদের এ শর্তে সাহায্য দিয়ে থাকে যে, ঐ সব বিদ্যালয়ে সরকারী শিক্ষানীতি অনুসারে বৈষয়িক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। পোল্যান্ডের যাবতীয় সরকারী বিদ্যালয়ে ও সরকারী আনুকূল্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক। বিভিন্ন ধর্মের স্বীকৃত সমিতিগুলোকে আপন আপন ধর্মের অনুসারীদের জন্য পাঠ্যসূচি নির্ধারণ ও বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা তদারক করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা লাভের পর এতদাঞ্চলের জাতি ও রাষ্ট্র যেসব গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তন্মধ্যে এখানকার শিক্ষা-ব্যবস্থাই ছিল প্রধান। যার মৌলিক সমাধান হওয়া অপরিহার্য ছিল সর্বপ্রথম। কেননা একটা আদর্শবাদী দেশ ও রাষ্ট্রের পক্ষে শিক্ষা সমস্যাই হয় জীবন মরণের সমস্যা। বিশেষ করে এ কারণে যে, উত্তরাধিকার সূত্রে এতদাঞ্চলের জনগণ যে শিক্ষা ব্যবস্থা লাভ করেছিল, তার প্রতিষ্ঠা ও রূপকার ছিল তাদেরই প্রাক্তন প্রভু সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। তারা এদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল তার স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করার জন্য তিনটি কথা মৌলিকভাবে মনে রাখতে হবে। একটি হল এই যে, ইংরেজ ছিল তখন পাশ্চাত্যের বস্ত্তবাদী সভ্যতার অগ্রণী। একটি বস্ত্তবাদী সাম্রাজ্যবাদী জাতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই বস্ত্তবাদী চিন্তা ও দর্শনমূলক হবে; নিতান্ত বৈষয়িক ও উপস্থিত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ এবং নীতিহীন ভোগবাদ ও স্বার্থবাদই হবে সে শিক্ষাব্যবস্থার মৌল দৃষ্টিকোণ। এটি খুবই স্বাভাবিক কথা এর ব্যতিক্রম ধারণামাত্র করার যেতে পারে না। আর দ্বিতীয় কথা হল, ইংরেজ ছিল এদেশের বিজয়ী প্রভু, মালিক-মুখ্তার। সেই প্রভুরা এতদঞ্চলের অধিবাসীদের, যাদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, তারা ছিল তাদের বিজিত গোলাম। গোলাম জাতির জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা তারা স্বভাবতই চালু করতে পারে না, যা গোলামদেরকে প্রভু বানিয়ে দিতে পারে কিংবা প্রভু হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারে। অন্য কথায়, গোলাম জাতিকে আরো গোলাম বানানোর উপযোগী শিক্ষাই তারা দিতে চেয়েছে, প্রভু বা স্বাধীন জাতির উপযোগী শিক্ষা নিশ্চয়ই দিতে চায়নি। আর তৃতীয়ত, একথাও উপেক্ষণীয় নয় যে, ইংরেজরা ছিল কট্টর খৃস্টান; তারা এই বিশাল অঞ্চলের রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল মুসলিমদের কাছ থেকে। আর এ রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেবার সময় তারা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল কেবলমাত্র মুসলিমদের তরফ থেকেই। এ কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষী এবং মুসলিমদের ঘোরতর দুশমন। তারা স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিল, মুসলিমদের জিহাদী শক্তির উৎস যে জীবন-দর্শন ও শিক্ষা ব্যবস্থা, তাকে নিঃশেষে খতম না করা পর্যন্ত এই লোকদের উপর ইংরেজ শাসনের মজবুত বুনিয়াদ কায়েম হতে পারে না।
তাই একথা পরিষ্কার যে, ইংরেজের প্রবর্তিত সে শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীন দেশ ও জনগণের জন্য কোন দিক দিয়েই উপযুক্ত ছিল না। দেশ-বিভাগের পর তা এখানে একদিনের তরেও চালু থাকা উচিত ছিল না, বরং অনতিবিলম্বে সে শিক্ষা ব্যবস্থা বদল করে এদেশের জনগণের উপযোগী একটি আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা একান্ত কর্তব্য ছিল। কিন্তু এ জাতির দুর্ভাগ্যই এখানে যে, এদেশে তা করা হয়নি। পাকিস্তান উত্তরকালে শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা নিশ্চিত ও নিষ্কন্টক করার জন্যই দিন-রাত ব্যতিব্যস্ত ছিল। মুসলিম জাতির আদর্শিক ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য অপরিহার্য ছিল যে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, তার প্রতি একবিন্দু দৃষ্টি নিক্ষেপের ফুরসতও তাদের হয় নি, কিংবা বলা যায় ইংরেজের নিকট থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার কোন পরিবর্তন সাধনেরই প্রয়োজন বোধ করেন নি তারা এবং তা করতেও চাননি। প্রয়োজন মনে করেননি এ কারণে যে, শাসনযন্ত্রের সাথে জড়িত সব লোকই ছিল ইংরেজের অনুরূপ জীবন-দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট ও আস্থাবান। ফলে স্বাধীন দেশ ও জনগণের বেলায় যে তার ব্যতিক্রম কিছু হওয়া দরকার, তার চেতনাটুকু তাদের মনে জাগেনি। তারা এ কাজ করতে চাননি এজন্য যে, তারা স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম নাগরিকদের উপযোগী এবং তাদের আদর্শিক চেতনার অনুরূপ শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে চালু করা হলে তা শাসকদেরই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলবে।
পাকিস্তান উত্তর যুগে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য যে কোন চেষ্টাই হয়নি, তা অবশ্য বলা হচ্ছেনা। এ পর্যায়ে যা চেষ্টা হয়েছে, সংক্ষেপে তা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে সর্বপ্রথম একটি নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান কায়েমের চার বছর পর ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিক এক শিক্ষা পরিকল্পনা রচনার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই সময় এ্যাডভাইজারী বোর্ড, কাউন্সিল অব টেকনিকাল এডুকেশন এবং ইন্টার ইউনিভার্সিটি বোর্ড-এর এক মুক্ত অধিবেশন হয়। এরপর ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে কমার্শিয়াল এডুকেশন কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়। ১৯৫৫ সালে প্রথম রচিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষা সম্পর্কেও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৬ সালে লাহোরে সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড একটি কমিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবাদি পেশ করে। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) সরকার শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠন করে ও তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ১৯৫৯ সালে ফীল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার সমগ্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনা করে দেশ ও জাতির প্রয়োজনের দৃষ্টিতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা রচনার লক্ষ্যে একটি ‘শিক্ষা কমিশন’ নিয়োগ করেন। এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর জাতিকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ লক্ষ্যে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২ সালে এক আদেশে ডক্টর কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের সদস্যগণ ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ভারত সফর করেন। এক মাসব্যাপী এ সফরে কমিশনের সদস্যগণ সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে কমিশন সরকারের কাছে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে।
রিপোর্টটি প্রকাশিত হবার পর পরই এটি বিতর্কিত হয়ে পড়ে। কমিশনের সুপারিশমালায় বেশ কিছু সুপারিশ ছিল যা প্রকৃতপক্ষে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর ও যুগোপযোগী এবং শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও সংস্কার বলা যায়। আবার সুপারিশমালার মধ্যে এমন কিছু মৌলিক দিক ও বিষয় ছিল যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খার বিপরীত এবং জনগণের চিন্তা-চেতনা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিক জীবনবোধের পরিপন্থী।
প্রকৃতপক্ষে কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন। অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির উপযোগী ধর্মবোধ বিবর্জিত একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। কমিশন নিষ্ঠার সাথে সে দায়িত্ব পালন করছে। কমিশন শিক্ষার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছে তাকে আদর্শিক দিক থেকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়; যথা- (১) সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির কর্মী তৈরি ও (২) ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা বিবর্জিত সেক্যুলার চিন্তা-চেতনা সৃষ্টি ও তার আলোকে ব্যবহারিক জীবন গড়ে তোলা। এ পর্যায়ে সরকারের শিক্ষা যা কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট থেকে প্রমাণিত হয়েছে তা পূর্বাপেক্ষা অধিক মারাত্মক রূপে দেখা দিয়েছে এ জাতির পক্ষে এবং সেই সাথে দীন-ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের দৃষ্টিতে এ রিপোর্ট হচ্ছে চরম কলঙ্কজনক ও নৈরাশ্যব্যঞ্জক। যেখানে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ইসলামী জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করার দায়িত্ব ছিল, সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেই দাবি করা হল যে, আদর্শ জাতি গঠনই এ সরকারের লক্ষ্য। অথচ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে তাও আদৌ যথার্থ নয়। যাইহোক এরপর ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহ্মানের আমলে ১৯৭৬ সালে প্রফেসর মুহাম্মদ শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ‘‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটি’’ গঠন করা হয়। ১৯৭৮ সালে শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. এইচ. এম. এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে শিক্ষামন্ত্রী ডক্টর আব্দুল মজীদ খানের নেতৃত্বে ‘মজীদ খান কমিটি’ গঠন করা হয়। ১৯৮৭ সালে অধ্যাপক মফিজুদ্দীন আহমদকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার আমলে কোন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়নি। তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বেসরকারী উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য কমিশন গঠিত হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার আমলে ডক্টর কুদরত-ই-কুদা রিপোর্টের’ ভিত্তিতে প্রফেসর মুহাম্মদ শামসুল হকের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিকে শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০১ সালে ৪ দলীয় জোট সরকার কায়েম হবার পর ডক্টর মুহাম্মদ মনীরুজ্জামান মিঞাকে চেয়ারম্যান করে ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩’ গঠন করা হয়। এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচিত বর্তমান শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারও যে শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছেন তার পুরোটাই ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলোতে যে লেখাপড়া (‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পর্যায়ের শিক্ষা) প্রচলিত আছে তা সম্পূর্ণই পশ্চিমা শিক্ষানীতিতে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। আবার মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তাতেও দু’টি ধারা বিদ্যমান একটি প্রাচীনতম ‘কওমী’ ধারা এবং অপরটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক ‘আলীয়া’ ধারা।
এখানে উল্লেখ্য যে, উপরিউক্ত শিক্ষা কমিশন ও কমিটিসমূহের রিপোর্ট ও সুপারিশমালার কোনটাই যথাযথ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই পূর্ববর্তী সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষা-ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায় এবং নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। ঐ সব সুপারিশে যারা একমূখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছেন তারা ধর্ম শিক্ষাকে বলতে গেলে বাদই দিয়েছেন। আর যারা ধর্ম-শিক্ষাকে বাদ দেননি তারা ধর্মীয় শিক্ষাকে ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার লেজুড় হিসেবে রেখেছেন। এ সব চেষ্টা-প্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি কথা বলাই যথেষ্ট এবং তা এই যে, বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ গতানুগতিকতার প্রবল প্রাধান্য অপরিবর্তিতই রয়েছে। তাই একথা নির্দিধায় বলা যায় যে, ‘জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও আজ পর্যন্ত এখানে আদর্শভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়নি।’
৭. মুসলিম সমাজে ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষানীতির বিরূপ প্রভাবঃ
ইংরেজ জাতি যখন মুসলিমদের উপর প্রভুত্ব করার সুযোগ পেলো তখন তা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করলো তা ছিল মুসলিমদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের মানসপুত্রে পরিণত করা। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়েছে। তারা জানতো যে, মুসলিমদেরকে যদি কুরআন-হাদীসের শিক্ষা থেকে ফিরানো না যায়, তাহলে তাদের উপর প্রভুত্ব করা যাবে না। তাই ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রধানমন্ত্রী মিষ্টার গ্লাডস্টোন হাউস অব কমন্সে দাঁড়িয়ে পবিত্র কুরআন মাজিদ হাতে নিয়ে বলেছিল ‘‘যতদিন না মুসলিমদের এই কুরআন থেকে বিমুখ করা যাবে ততদিন তাদের উপর শান্তির সঙ্গে প্রভুত্ব করা যাবে না।’’ তাই তারা মুসলিমদেরকে কুরআন বিমুখ করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তাতে সফলকাম হয়েছে। অত:পর তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নিম্নের কাজগুলো শুরু করেছিলঃ
১. ইসলামী আইন-কানুন ও ইসলামী আদর্শকে কুৎসিৎ থেকে কুৎসিতরূপে সমাজের সম্মুখে তুলে ধরা, যেন মুসলিমদের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে পবিত্র ধারণা ছিল তা নষ্ট হয় এবং ইসলামের প্রতি যেন প্রত্যেকেরই একটা ঘৃণাভাব সৃষ্টি হয়।
২. ইসলামকে একটা আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে প্রচার করা।
৩. আল-কুরআন শুধু বানান করে পড়লেই অনেক সওয়াব হবে, তা অর্থ বুঝে পড়ার দরকার নেই- এ কথা বুঝানো। আমরা প্রত্যেকেই বুঝি যে, পড়ার অর্থ হলো বুঝে পড়া। কিন্তু একমাত্র আল-কুরআন যা বুঝে পড়ার বেলাতেই আমাদের ভুল ধারণা যে, তা বুঝে পড়ার পরিবর্তে শুধু বানান করে পড়লেই কুরআন তিলাওয়াতের হক আদায় হয়ে যায়।
৪. তারা মুসলিম ছাত্রদের আরো শিখালো- (ক) ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থহাই উত্তম; (খ) তাদের অর্থব্যবস্থাই উন্নততর; (গ) তাদের সমাজব্যবস্থাই আদর্শস্থানীয়; (ঘ) তাদের গণতন্ত্রই যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য; (ঙ) ফরাসী বিপ্লবই মানবাধিকারের প্রতি প্রথম স্বীকৃতি দেয়। অথচ এই প্রত্যেকটি পাশ্চাত্যরীতিই ঘৃণিত যেমন তাদের সমাজব্যবস্থায় মূলত: পারিবারিক অশান্তির বীজ রোপিত যেখানে সমাজ ভাঙ্গার করুণসুর রণিত। তাদের অর্থব্যবস্থা যার ভিত্তি মূলত: সুদের উপর প্রতিষ্ঠিত যা দরিদ্রকে আরো দরিদ্র ও ধনীকে আরো ধনী করে সমাজে সম্পদের অসমবন্টন নিশ্চিত করে। পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা মূলত: অশ্লীলতার স্রোতে ভাসমান। তাদের গণতন্ত্র সমাজে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির প্রসার করে। আর ফরাসী বিপ্লবতো সেদিনের ঘটনার তারও বহু আগে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রণীত মদীনা সনদই হচ্ছে পৃথিবীতে মানবাধিকারের প্রথম স্বীকৃতি।
অথচ, তারা এই ধরণের শিক্ষার মাধ্যমে কৌশলে ও চুপিসারে মুসলিম ছাত্রদের ব্রেন ওয়াশ করে দেয়। ফলে ইসলামের সঙ্গে শত্রুতার ব্যাপারে আজ অমুসলিমদের চেয়েও মুসলিম শিক্ষিত সমাজই হলো বেশি তৎপর। তারা শিক্ষাগার থেকে বের হয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তেহরানে ২৮তম আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ব্যাক্তিদের সঙ্গে এক সাক্ষাতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ্ আলী খামেনী বলেনঃ ‘‘আল-কুরআনের মহান শিক্ষা এড়িয়ে জাতিগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন কাজ।’’ তেহরান বেতারের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ইরনা এ কথা জানিয়েছে। যার বাস্তব উদাহরণ আল-কুরআনের শিক্ষা বর্জিত পাশ্চাত্য শিক্ষিত মুসলিম নামধারী ব্যাক্তিদের মধ্যে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
৮. বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ধারার শিক্ষাক্রমঃ
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাক্রম মূলতঃ তিন প্রকারঃ (ক) বাংলা মাধ্যমের সাধারণ শিক্ষা, (খ) মাদ্রাসার ইসলামী শিক্ষা এবং (গ) পাশ্চাত্য মডেলের ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা।
৮.১ বাংলা মাধ্যমের সাধারণ শিক্ষা ঃ
বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজগুলো সবই এই শিক্ষাবোর্ডের অধীনে বাংলা মাধ্যমের সাধারণ শিক্ষার আওতাভূক্ত। এ শিক্ষাক্রমের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্য ব্যতীত প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভূগোল, সামজবিজ্ঞান, পৌরনীতি, ইতিহাস, দ্বীনিয়াত প্রভৃতি। এক্ষেত্রে প্রণীত পাঠ্যপুস্তক সমূহ সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত। এমনকি জীবন-দর্শন, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত লেখাগুলোও সম্পূর্ণ ইসলাম ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। এই শিক্ষানীতিতে মক্কা ঘোষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কোন প্রতিফলন ঘটে নি। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষানীতিকে মক্কা ঘোষণার সাথে সঙ্গতিশীল করতে হলে শিক্ষানীতির কিছু শব্দ বা বাক্য পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য চাই শিক্ষানীতির সার্বিক পুনর্গঠন। ১৯৮১ সালের আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে মুসলিম দেশের রাষ্ট প্রধানগণ শিক্ষা সম্পর্কিত পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন দীর্ঘকাল যাবৎ বলতে গেলে এটা প্রকাশ না করে চেপে রাখা হয়েছে। শুধু আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগ ও সরকারী প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে নিজেরা নিশ্চেষ্ট থাকলেই সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। জনমত সৃষ্টির জন্যে ইসলামী শিক্ষার রূপরেখা ও তার মডেল সামজে স্থাপন করতে হবে। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রাখতে হবে এবং তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ থাকতে হবে। একটা সঠিক নীতিমালা তৈরী ও তদানুযায়ী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং সে আলোকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে মডেল সৃষ্টি করতে হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ইসলামকি এডুকেশন সোসাইটি, আল-হিক্মাহ্ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এই লক্ষ্যে তাদের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু প্রচেষ্ঠা খুবই অপ্রতুল।
৮.২. মাদ্রাসার ইসলামী শিক্ষা ঃ
বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা দু’টি ধারায় বিভক্তঃ (ক) বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ও (খ) বাংলাদেশ কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষা।
৮.২.১. আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমঃ
বাংলাদেশের সমস্ত আলীয়া মাদ্রাসাগুলো জাতীয় সরকার নিয়ন্ত্রীত বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত। ‘এ বোর্ডের আওতাভূক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা বর্তমানে ৬৮৩৮ টি।’ ‘উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৭৮১ সালে লর্ড ওয়ারেন হেষ্টিংস মুসলিম যুবকদিগকে আইন-আদালতের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আরবী ও ফারসি শিক্ষার জন্য বিখ্যাত কলিকাতা মাদ্রাসা স্থাপন করেন।’ এটিই ছিল উপমহাদেশের প্রথম আলীয়া মাদ্রাসা যার উত্তরসূরী বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের আলীয়া মাদ্রাসা গুলো। যাইহোক এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’ - এর আওতাধীন আলীয়া মাদ্রাসা গুলো। ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড নিম্ন্স্তরের জন্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে সক্ষম হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই রচনা করতে সক্ষম হয় নি। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড প্রণীত পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৩ সালের পর সরকারীভাবে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নে আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৯৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে আট শতাধিক মাদ্রাসার অনুদান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত একমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডটিও সরকারী বৈষম্যের শিকার।’
৮.২.২. কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমঃ
বাংলাদেশের বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সমস্ত কাওমী মাদ্রাসাগুলো বাংলাদেশ কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের আওতাধীন। ১৮৭০ সালের দিকে উল্টর ভারতে দেওবান্দ, সাহারানপুর, মুরাদবাদ, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি স্থানে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা সমূহের অনুকরণে এদেশের কওমী মাদ্রাসা সমূহ পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে দারুল উলূম দেওবান্দের আদর্শ, উদ্দেশ্য, নিসাব ও শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণে স্থাপিত সর্বপ্রথম কওমী মাদ্রাসা হলো মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। চট্টগামরে অন্তর্গত হাটহাজারী থানায় ১৯০১ সালে এই মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ইসলামিয়াতের দিকে গভীর জ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাদের গৃহীত শিক্ষাপদ্ধতি প্রচীনতম। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কওমী মাদ্রাসা বাংলার পাশাপাশি আরবী, উর্দ্দু ও ফারসি ভাষায় লিখিত বই পাঠ্য করা হয়েছে। কোন কোন বিষয়ের পাঠ্য বইসমূহ শতাব্দী প্রাচীন। তবে কাওমী মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করলে যুগোপযোগী শিক্ষিত না হতে পারলেও একজন খাঁটি মুসলিম ও ইসলামী পন্ডিত হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ এর পাঠ্যসূচীতে রাখা হয়েছে।
৮.৩. পাশ্চাত্য মডেলের ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষাঃ
আমাদের দেশের বেসরকারী ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলোতে যে লেখাপড়া (‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পর্যায়ের শিক্ষা) প্রচলিত আছে তা সম্পূর্ণই পশ্চিমা শিক্ষানীতিতে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকাস্থ ব্রিটিশ কাউন্সিলে কেন্দ্রিয় পরীক্ষাগুলোতে অংশ গ্রহণ করে যা দেশের বাহির থেকে প্রধানত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ‘এই ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষায় বাংলা ও আরবী ছাড়া সমস্ত কোর্সগুলোই ইংরেজী বইয়ের মাধ্যমে ইংরেজীতে শিক্ষা দেওয়া হয়।’ এগুলোর অধিক পরিমাণ ব্যয়বহুল হওয়ার শুধু সমাজের বিত্তশালী পরিবারের ছেলে মেয়েরাই এর শিক্ষা সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে।
৯. একমুখী ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাঃ
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কাওমী মাদ্রাসা বোর্ড (বেফাক) এর আওতাভূক্ত কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম, বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ড এর অধীনে সমস্ত আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আওতাভূক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজিয়ে, এখানে পরবর্তী ২০ নং অংশে বর্ণিত, উল্লেখিত সুপারিশমালার আলোকে নৈতিকতাপূর্ণ যুগোপযোগী একমুখী ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণোয়ন অধিক যুক্তিযুক্ত যা একই ইসলামী মনোভাব সম্পন্ন নতুন মুসলিম প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্য অর্জনে অধিক ফলপ্রসু হবে। তবে আমাদের দেশের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলোতে যে লেখাপড়া (‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পর্যায়ের শিক্ষা) প্রচলিত আছে তা যেহেতু সম্পূর্ণই পশ্চিমা শিক্ষানীতিতে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত সুতরাং এগুলোকে আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতির বাহিরে রাখাই বাঞ্চনীয়।
১০. প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির সাধারণ ত্রুটিঃ
শিক্ষা অর্থ জানা, বুঝা বা হৃদয়ঙ্গম করা। আজানাকে জানা, অবোধ্যকে বুঝা আর অশেখাকে শেখা। বস্ত্তত শিক্ষাই মানুষকে মানুষ করে। শিক্ষা ব্যতিরেকে মানুষ মানুষ নামের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষা মানুষের জন্য অপরিহার্য মৌলিক প্রয়োজন।
মানুষের বস্ত্তগত দিকটাকে বড় করে দেখে পাশ্চাত্যদর্শন আমাদেরকে শিক্ষা দিল- মানুষ জন্তু-জানোয়ারের একটি পরিবর্তিত স্তর বৈ আর কিছু নয়। সমগ্র জীবজগতে বেঁচে থাকার একটা প্রতিযোগিতা চলছে। যার শক্তি আছে সেই টিকে থাকবে, অর্থাৎ যোগ্যতমেরই উদ্ধর্তন! সবল দুর্বলকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এটাই নাকি নিয়তি। তাই ভোগের সংসারে বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার জন্য যত ইচ্ছা ভোগবিলাস করে যাও। পক্ষান্তরে আরেকটি দল মানুষের বস্ত্তগত দিকটাকে বাদ দিয়ে আধ্যাত্মবাদের দিকে চরমভাবে ঝুঁকে পড়েছে। তারা মানুষের দেহের দাবির প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে। তারা বলে, সংসার ঝামেলার স্থান তাই এখান থেকে পালাও।
এ দুই প্রান্তিক দলের কেউই আসল মানুষের সন্ধান পায়নি। মানুষ তো শুধু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমষ্টির নাম নয়। আবার আত্মাই মানুষের একমাত্র পরিচয় নয়। দেহ হচ্ছে আত্মার বাহন আর আত্মা দেহের সহিস। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দেহটি দান করেছেন এ সৃষ্টিকে উপভোগ করার জন্য। দেহের তাগিদেই সৃষ্টিকে তন্নতন্ন করে নানা রহস্য উদঘাটন করতে পারবে মানুষ। আবার দেহের পবিত্রতার জন্য আত্মাকেও সে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখবে। ইসলামী শিক্ষাদর্শন মানব মনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। শুধু উত্তরের জন্যই উত্তর দেয়া হয়নি, সত্যকে সত্য বলে ঘোষণা করেছে আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে চিহ্নিত করেছে। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনকে অতিসতর্কতা সহকারে বিবেচনা করে সামঞ্জস্য বিধানের একটা সুষ্ঠু ও সঠিক চেষ্টা করা হয়েছে।
ইসলাম বলে, এ সৃষ্টিলোক কোন আকস্মিক বস্ত্ত নয়, বরং সুপরিকল্পিত। এর পেছনে একজন শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এটির অস্তিত্ব দান করেছেন। সৃষ্টির সেরা মানবগোষ্ঠী; মানুষের উপকারের জন্য সারা বিশ্ব, সৃষ্টিরাজিকে ব্যবহার করতে হবে- কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ সৃষ্টিকে বিভিন্ন আকারে ও প্রকারে ব্যবহার করতে পারে। মানুষ তার বস্ত্তগত প্রয়োজন মেটাতে কিংবা মানসিক উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে এ সৃষ্টিলোক নিয়ে চিন্তা-গবেষণা কিংবা কারিগরি শিল্পের উন্নতি সাধন করতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ একটি নৈতিক জীব। নৈতিকতাই তার বৈশিষ্ট্য। তাই তার জ্ঞানের বিকাশের সাথে থাকবে নীতিবন্ধন। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে তাকে অনেক বিষয়েই জ্ঞান আহরণ করতে হবে, জানতে হবে অনেক কিছু। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে কোথাও নৈতিকতা হারালে বা ভুলে গেলে চলবে না। সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাকে রাজনীতি চর্চা করতে হবে। তার বস্ত্তগত প্রয়োজন মেটাতে তাকে অর্থনীতির চর্চা করতে হবে। স্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চা করতে হবে। এ ধরণের অসংখ্য প্রয়োজনে অসংখ্য শাস্ত্র তার অধ্যয়ন ও অনুশীলন করতে হবে। কিন্তু সবকিছু আলোচনা ও চর্চা হতে হবে ঐ একই জীবন-দর্শনের ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার প্রথম শ্রেণী হতে শেষ পর্যন্ত যা কিছু পড়ানো হয় তাতে ইসলামের জীবন দর্শন আদৌ প্রতিফলিত হয়না।
প্রতিটি বিষয় আলোচনা কালে যদি নৈতিক দৃষ্টিকোণ না থাকে, যদি সেগুলো নৈতিকতার রসে সিঞ্চিত না হয়, তবে শুধু আলাদাভাবে দীনিয়াত বা ইসলামিয়াতের লেজুড় জুড়ে দিলেই সাধারণ শিক্ষা ইসলামী শিক্ষা হয়ে যায় না; তা বরং কাকের পুচ্ছে ময়ূরের পালক জুড়ে দেয়ার মতোই হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে। এ ধরণের সংমিশ্রণে হিতে বিপরীত ফলই হয়ে থাকে। এর ফলে ধর্ম ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার্থী আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাতের প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তার সন্ধান পায় না; বরং অন্যান্য ক্ষেত্রে তাকে দেখানো হয় এ বিশ্ব-চরাচরে আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাতের কোন প্রয়োজন নেই। এগুলোকে বাদ দিয়েও আমরা সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি। প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীকে এ কথাই শিখিয়ে দেয়া হয়- আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাতের কোন অস্তিত্ব নেই, আর থাকলেও তাদের কোন প্রভাব মানব জীবনে নেই। মানুষ স্বাধীন সত্তা নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের অধিকারী। আল্লাহকে যদি একান্তই মানতে হয়, তবে তাঁকে আকাশরাজ্যেই স্থান দাও, জমিনে তাঁর কোন প্রভুত্ব নেই।
ঐ একই শিক্ষার্থী যখন ইসলামের সবক নেয় তখন সে জানতে পায়, এ আকাশ-পৃথিবী ও এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র আইনে চলছে আর মানুষকেও তাই সেই আল্লাহর আইন-কানুনেই চলতে হবে। ক্লাসের সাতটি পিরিয়ডের ছয়টি পিরিয়ডেই সে যে বাস্তব শিক্ষা পেল তা আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাতের প্রভাবমুক্ত। আর মাত্র একটি পিরিয়ডে সে শিখল আল্লাহকে উপাস্য ও প্রভু হিসেবে জীবনে মেনে চলতে হবে। তাই পরস্পর বিরোধী এ দু’টি দর্শনের সংঘর্ষে থিওরী পর্যায়ে নামমাত্র ইসলামী শিক্ষারই হার মানতে হয়। বর্তমানে ধর্ম শিক্ষাকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার যে গালভরা বুলি শুনতে পাওয়া যায় তা এমনিভাবেই অর্থহীন- শুধু অর্থহীনই নয়, মারাত্মক হয়ে দেখা দেয় শিক্ষার্থীর জীবনে। দীর্ঘ ষোলটি বছর ধরে একজন শিক্ষার্থী দেখা ও শেখার মাধ্যমে বুঝে নিল যে, ব্যাংক ব্যতীত দুনিয়া চলে না আর সুদ ব্যতীত ব্যাংকও চলে না। অতএব সুদ ব্যতীত দুনিয়া অচল। প্রচলিত অর্থনীতি এ ধরণের চিন্তাধারাই সৃষ্টি করে। এই শিক্ষার্থীকে যখন ইসলামিয়াতে শিখানো হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন, তখন সে দিশেহারা হয়ে যায়।
আমাদের দেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষা যদিও একদিক দিয়ে কুরআন-হাদীসের জ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তবুও এ শিক্ষা জাতির পথ-নির্দেশ করতে সক্ষম হচ্ছে না। জীবন পরিক্রমাকে পারছেনা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এ শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামকে অত্যন্ত পঙ্গু ও খোঁড়া হিসেবে পেশ করছে। ইসলাম যে সামগ্রিক জীবন-বিধান এবং যুগ-সমস্যার একমাত্র সমাধান- এ কথা বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে মাদ্রাসা হতে পাশ করে যারা বেরুচ্ছে, তারা জাতির নেতৃত্বদানে অক্ষমতা প্রদর্শন করছে। তাই আমরা পূর্ণাঙ্গ ইসলামের পরিচয় পাচ্ছি না তাদের মধ্যে- না তাদের জ্ঞানে, না তাদের কর্মজীবনে।
তাই আমাদের শিক্ষা সমস্যার একমাত্র সমাধান হল এই যে প্রচলিত দু’টি শিক্ষাব্যবস্থাকে একত্রিত করে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে একটি স্বাধীন মুসলিম দেশের শিক্ষার্থীরা চলতি দুনিয়ার সর্বস্তরে নিজেদের আসন গেড়ে বসতে পারে। আমাদের জাতীয় আদর্শ যে ইসলাম, শিক্ষা সংস্কারের নামে সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। অতএব, আমাদের শিক্ষার এ মৌল সমস্যার সমাধান হতে হবে সর্বাগ্রে- সর্বপ্রথম। এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কোন সমস্যারই সমাধান হতে পারে না। এ কথা আমরা-দেশের শাসন কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দেশবাসী- যতো তাড়াতাড়ি বুঝতে পারব, ততই মঙ্গল।
১১. সহশিক্ষার কুফলঃ
‘সহশিক্ষা মানে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই একই বিষয় একই কক্ষে পাশাপাশি বসিয়ে শিক্ষা প্রদান। এ পর্যায়ে প্রথম কথা হলঃ ছেলে ও মেয়ে জন্মগতভাবেই স্বতন্ত্র দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা এবং ভাবধারার ধারক হয়ে থাকে। জীবনের পরিণত স্তরে স্বাভাবিক দায়িত্ব বোধের তাগিদেই তারা স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্র গ্রহণে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে কোন মিলই থাকে না ছেলে ও মেয়ের জীবনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উভয়কে ঠিক একই বিষয় একই ধারায় শিক্ষা দেয়ার পরিণাম যে কত ভয়াবহ, তা ভাষায় প্রকাশ করা চলে না।’ এখানে সবার প্রথমে যে বিষয়টি আসে তা হচ্ছে আল-কুরআনে মুসলিম নারীদের জন্য নির্দের্শিত আবশ্যকীয় বিষয় ‘পর্দা’-র খেলাপ। ‘আপন স্ত্রী কিংবা কোন মুহাররাম মহিলাকে ছাড়া অপর কোন মহিলাকে নজর ভরে দেখা কোন পুরুষের জন্য জায়েয নয়।’ ‘আল-কুরআনে প্রথমেই নারী ও পুরুষকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা এইযে, ‘দৃষ্টি অবনমিত কর’। অর্থাৎ কারো মুখমন্ডলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে তা নিম্নমুখী করতে হবে। এটা আল-কুরআনের ‘গাদ্দে বাছার’ শব্দের শাব্দিক অর্থ। কিন্তু এর দ্বারা পূর্ণ মর্ম পরিষ্কার হয় না। আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশের প্রকৃত উদ্দেশ্য এই নয় যে, মানুষ সকল সময় নীচের দিকে দেখবে এবং উপরের দিকে কখনও তাকাবে না। বরং প্রকৃত উদ্দেশ্য এইযে, মানুষ ঐ বস্ত্ত থেকে নিজেকে রক্ষা করুক যাকে হাদীসের পরিভাষায় ‘চোখের ব্যভিচার’ বলা হয়েছে। অপর নারীর রূপ সৌন্দর্য দর্শন করে আনন্দ উপভোগ করা পুরুষের জন্য যেমন আনাচার সৃষ্টিকারী তেমনি অপর পুরুষের প্রতি তাকিয়ে দেখাও নারীর জন্য অনাচার সৃষ্টিকারী। অনাচার-বিপর্যয়ের সূচনা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিগতভাবে এখান থেকেই হয়। এজন্য ইসলাম সর্বপ্রথম এই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। দৃষ্টি আবনমিত করণের আসল উদ্দেশ্য এটাই।’ ‘নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইউরোপের বিভিন্ন জাতির সভ্যতা ও সমৃদ্ধির বড় সর্বনাশ সাধন হয়েছে যেমন এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সুবিদিত যে, গ্রীক সভ্যতার পতনের একটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নারীর বেলেল্লাপনা, পুরুষদের সাথে তাদের অবাধ মেলামেশা এবং অতিমাত্রায় প্রকাশ্য সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শনী।’ ‘বিখ্যাত ফরাসী চিন্তাবিদ আলেকসিম ক্যারেল (২৮ জুন, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ-০৫ নভেম্বর, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘‘Man the Unknown’’-এ লিখেছেনঃ ‘‘পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে পার্থক্য তা মৌলিক পর্যায়ের। তাদের দেহের শিরা উপশিরা, স্নায়ূ সবকিছু ভিন্নরূপ বলেই তাদের এই পার্থক্য বিদ্যমান। নারীর ডিম্বকোষ থেকে যে রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয় তার প্রভাব নারী দেহের প্রতিটি অংঙ্গে প্রতিফলিত হয়। নারী ও পুরুষের স্বভাবগত ও মনস্তাত্বিক বিভিন্নতার কারণও একই।’’ পুরুষ ও নারী মানুষ হিসাবে অভিন্ন হলেও তাদের দৈহিক ও মানসিক গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, প্রকৃতি তাদের থেকে পৃথক ধরনের কাজ নিতে ইচ্ছুক। একই ধরনের কাজ প্রকৃতি তাদের কাছ থেকে নেওয়ার পক্ষপাতি নয়। এবং এই সৃষ্টি রক্ষার প্রয়োজনেই উভয়ের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখা একান্ত জরুরী।’ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিদ্যা- এ ধরণের সব বিষয়েই যে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্যই শিক্ষণীয় জিনিস রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সে শিক্ষায় ছেলে ও মেয়ের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি একরূপ হয়না কখনো। কাজেই একই কক্ষে বসিয়ে, একই ভঙ্গিতে একই বই পড়ানো ও একই দৃষ্টিকোণ দিয়ে একই বিষয় ছেলে ও মেয়েকে শিক্ষা দেয়ার মানে হল ছেলে ও মেয়েকে মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন করে তোলা। আর এটা যে স্বভাব ও প্রকৃতির শুধু বিপরীতই নয়, মানবতার পক্ষে মারাত্মকও, তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। এর ফলে ছেলেরা মেয়েলী স্বভাব-প্রকৃতির ধারক হবে-পৌরুষ হারিয়ে ফেলবে আর মেয়েরা পুরুষোচিত মন-মেজাজ লাভ করবে, হারিয়ে ফেলবে সব নারীসুলভ কমণীয়তা, তা বর্তমানের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও অনায়াসে বুঝা যায়। বলা বাহুল্য যে, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বর্তমান উচ্ছৃংখলতার মূলে প্রধানত এ কারণই নিহিত। দ্বিতীয়ত: ছেলে ও মেয়েকে একই কক্ষে বসিয়ে শেখানোর পরিণাম হল, হয় ছেলে ও মেয়েদের স্বাভাবিক যৌনবোধকে চিরতরে নির্মূল করে দেয়া এবং মানব সমাজে ক্লীব লিঙ্গের প্রাদুর্ভাব ঘটানো, না হয় যৌনবোধের উস্কানি সৃষ্টির মাধ্যমে যৌনচর্চা ও যৌন পরিতৃপ্তির এক অশ্লীল প্রবাহ সৃষ্টি- যার ফলে নৈতিকতার সব বাঁধনই ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যাবে। আর মানবাকৃতির এ জীবগুলো এক নতুন পশু শ্রেণীর রূপ ধরে সমাজে পাশবিকতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে। মনে রাখতে হবে, এ সহশিক্ষা নীতি মুসলিম জাতি কোনদিনই গ্রহণ করেনি, তারা তা চালুও করেনি। আমাদের নীতিহীন ও চরিত্রহীন ইংরেজ প্রভুরাই এ গোলাম জাতির চরিত্র ধ্বংস করার কু-মতলবে এবং আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে সম্পূর্ণ চরিত্রহীন রূপে গড়ে তোলার চক্রান্ত হিসেবে এদেশে এ সহশিক্ষার প্রচলন করেছিল। বস্ত্তত এ সহশিক্ষা নীতিতে সত্যিকারের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না কিছুই, বরং সমাজের যুবক-যুবতীদের পশুত্বের নিম্নতম পংকে ডুবে যাবার উৎসাহই দেয়া হচ্ছে সর্বতোভাবে। একশ্রেণীর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী পাশ্চাত্যপন্থী বুদ্ধিজীবিদের প্ররোচনায় আধুনিক এবং সহশিক্ষার নামে আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নিয়মিত চলছে নগ্নতা ও বেহায়াপনা, চলছে ভাব বিনিময়, নষ্টামী চর্চা এবং বেলেল্লাপনা। কোথায় তাদের লেখাপড়া ? কোথায় তাদের সাহিত্য চর্চা? এগুলো সবই তথাকথিত আধুনিক এবং সহশিক্ষার কুফল। তারা কি জানে না তাদের দেবতূল্য পাশ্চাত্য প্রভূদের দেশের শিক্ষাঙ্গনে সহ শিক্ষার নামে আজ কি চলছে? যৌন নিপীড়নের ঘটনা সেখানকার স্কুল-কলেজ গুলোতে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ইউরো-আমেরিকান সমাজের ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ২৩% থেকে ৪৪.৮% ছাত্রী ছেলে বন্ধুদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।’ এখানে সবচেয়ে মর্মাহত হওয়ার মত ব্যপার এই যে, শিশুরাও যৌন নিপীড়ন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কানাডার ৫৪% নারী বলছে তারা ১৬ বছর বয়সে পদার্পণের আগেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে (সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩১ জুলাই, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ)। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব ব্যাংক এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয় নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, বার্বাডোস ও নেদারল্যান্ডের নারীদের প্রতি তিন জনের একজন শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। (সূত্রঃ Social Problems. Page-92)
আমাদের সমাজে দৃশ্যমান সহশিক্ষার মৌলিক ক্ষতিকর দিকগুলো নিম্নে দেখানো হলোঃ
(ক) তরুণ শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে আল-কুরআনে কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ ‘যিনা-ব্যভিচার’- এর ব্যাপক চর্চা ঘটছে।
(খ) অবৈধ যৌনাচারের ফলে যুবক-যুবতীদের মধ্যে নানাবিধ জটিল যৌন রোগের প্রার্দুভাব ঘটছে।
(গ) সামজে ‘ধর্ষণ’, ‘জারজ সন্তান’ এবং ‘ভ্রুণ হত্যা’ ব্যাপক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
(ঘ) বিপদগামী যুবতীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(ঙ) যুবক-যুবতীরা শিক্ষাগারে একে ওপরের সান্নিধ্যে এসে পরস্পর অবৈধ প্রণয়নের শিকার হচ্ছে।
(চ) তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে ‘লিভিং টুগেদার’ নামক ঘৃণীত পাশ্চাত্য রীতির ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটছে।
(ছ) ‘ইভ টিজিং’ নামক সামাজিক সমস্যার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে।
(জ) বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজাত আকর্ষণে প্রায়শই ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পাঠ্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে।
(ঝ) লাজুক ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অস্বস্তী বোধ করে বিধায় প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসর থেকে তাদের আশানুরূপ ফল আসছে না।
১২. শিক্ষাব্যবস্থায় সেক্যুলারিজমের প্রভাবঃ
ধর্মীয় প্রবণতাকে মানুষের ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার নামই হচ্ছে সেক্যুলারিজম (Secularism) যার বাংলা অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এর লক্ষ্য। সে হিসেবে এ মতবাদকে ধর্মহীনতা বলাই সমীচীন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের বিধান মেনে চলার বিরুদ্ধে এর কোন বিশেষ আপত্তি নেই বলে এ মহান ‘উদারতার’ স্বীকৃতি স্বরূপ এর নাম ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা হয়েছে।
ধর্মমুক্ত সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা পরজীবনের ধারণা থেকে মুক্ত। সেক্যুলার জীবন-দর্শন মানুষকে বানরের বংশধর মনে করে। এ শিক্ষা মানুষকে ইতর প্রাণীর থেকে খুব বেশি মর্যাদা দেয় না। মানুষের সত্যিকার পরিচয়, তার মর্যাদা এবং দায়িত্ব-কর্তব্য এ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নির্ণিত হয় না। যার কারণে নাস্তিক্যবাদী সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে শুধু ভোগবাদী ও দুনিয়া পূজারীই করে তোলে। বস্ত্তবাদী শিক্ষা ও জীবন দর্শন মানুষের দুনিয়াবী জিন্দেগী ও দৃশ্যমান জগতকেই একমাত্র সত্য ও চূড়ান্ত বলে মনে করে। এই দৃশ্যমান জগতের বাইরের বিশাল-বিস্তীর্ণ পারলৌকিক জীবনের অস্তিত্ব ধর্মমুক্ত সেক্যুলার শিক্ষা-দর্শন স্বীকার করতে চায় না। যার কারণে সেক্যুলার শিক্ষা ও দর্শনে শিক্ষিত লোকেরা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও বিত্ত-বৈভবকেই জীবনের চূড়ান্ত সফলতা মনে করে এবং তাদের শিক্ষা-দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে ওঠে অর্থ উপার্জন। এ ধরণের শিক্ষা দিয়ে অনেক তথাকথিত জ্ঞানী-গুণী তৈরি হলেও প্রকৃত মানুষ তৈরি হয় খুবই কম। জ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার জন্য ধর্মভিত্তিক শিক্ষা অপরিহার্য। মানুষের সত্যিকার পরিচয় এবং মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর যথার্থ বিকাশ আমরা কেবল ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমেই লাভ করতে পারি।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ডারউইনের অনুসারীরা মনে করেন মানুষ বানরের বংশধর এবং মানুষের আদিপুরুষ কোন মানুষ ছিল না, মানুষ প্রথমে ছিল ইতর প্রাণী মাত্র। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ইতর প্রাণী বানর এক সময় মানুষে পরিণত হয়েছে। বস্ত্তবাদী জ্ঞান ও মতবাদগুলোর কাছ থেকে আমরা মানুষ সম্পর্কে উচ্চতর কোন ধারণা, মানুষের কোন মহত্তর পরিচয় ও আদর্শ যেমন পাই না, তেমনি এ পৃথিবীতে মানব জীবনের বিশেষ কোন মিশন আছে কিনা তাও আমরা জানতে পারি না। সেক্যুলার শিক্ষা-দর্শন মানুষকে বড়জোর পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মনে করে থাকে। মানুষ সম্পর্কে যদি এ রকম ধারণা দেওয়া হয় যে, মানুষের সৃষ্টি বানর বা পশু থেকে তাহলে মানুষ নিজের মধ্যে পশু প্রবৃত্তির লালন-পালনে তৎপর হলে সেক্ষেত্রে মানুষকে কি দোষী সাবস্ত করা যায়? ডারউইনের থিওরি Survival of the fittest যা কিনা বন্য প্রাণির (Wild life) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু শিক্ষাবিদগণ সেটাকেই মানুষের ওপর প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়েছেন। ফলে আধুনিক শিক্ষার সামনে বৈষয়িক লক্ষ্য ছাড়া আর কিছু নেই। আসলে এটা বস্ত্তবাদী শিক্ষা ও আদর্শের সীমাবদ্ধতা মাত্র। ধর্মকে যদি আমরা অস্বীকার করি, তাহলে আমাদের চর্মচোখে এবং আমাদের সীমাবদ্ধ উপলব্ধির সাহায্যে মানুষ সম্পর্কে এর বেশি কিছু তো আমরা আসলেই জানতে পারি না। কিন্তু মহাগ্রন্থসমূহ বিশেষ করে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানুষকে শুধু উন্নত পরিচয় ও মর্যাদাই প্রদান করেনি, অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, দায়িত্ব ও কর্তব্যও জানিয়ে দিয়ে মানব জীবনের এক মহত্তর আদর্শও নির্ধারণ করে দিয়েছে। আল-কুরআনের সূরা বাকারায় আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُونَ-
‘‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতারা বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্ঠি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুনকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমার জান না।’’ (সূরা আল-বাকারা-৩০)
মহান আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রথম কথাই বলেছেন যে, ‘‘প্রতিনিধি’’ প্রেরণ করেছি। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, প্রতিনিধি শব্দ ব্যবহারের মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলার মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য পরিস্ফুট। আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার কারণেই মানুষের মর্যাদা দুনিয়ার সকল সৃষ্টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং উন্নত। দুনিয়ার প্রতিটি বস্ত্তই তার অধীন এবং তার ব্যবহারের জন্য নিয়োজিত। আল্লাহর নির্ধারিত পন্থায় তা থেকে সে খিদমাত গ্রহণ করার অধিকারী।
১৩. উদার মতাবলম্বী শিক্ষার ব্যর্থতাঃ
আধুনিককালে উদার মতাবলম্বী শিক্ষা উদ্দেশ্যমূলক এবং আদর্শের প্রতি নিরপেক্ষ হয়ে পড়ে। অন্য সব বিবেচনার বিপক্ষে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের উপর জোর দেয়া হলো। শিক্ষাকে ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকে পৃথক করা হলো। স্বাধীনতাই হলো শেষ কথা। বিষয় ও পাঠ্যসূচীতে নৈর্বাচনিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হলো যে, একজন ছাত্রকে তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও উন্নত করার জন্যে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতে হবে এবং তার চিন্তাধারা চরিত্রকে বিশেষ ছাঁচে গড়ে তোলার জন্য বাহিরের প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। এ ধরনের শিক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল প্রচলিত এবং আনেক ইউরোপীয় দেশেও তা সমাদৃত হয়েছে।
উদার মতাবলম্বী শিক্ষা যে ফল উৎপাদন করেছে তা মোটেই উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। গুরুত্বপূণ কয়েকটি পরিণতি নিম্নে বর্ণিত হচ্ছেঃ
(ক) এ শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক দৃষ্টি বা ধারণা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। যখন কোন জাতি তাদেরকে ত্যাগ ও কর্মে উদ্দীপিত করার মতো আদর্শের অভাবে পড়ে তখন ক্রমশ তারা ইতিহাসের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের পতন শুরু হয়।
(খ) এ শিক্ষা নতুন প্রজন্মের আত্মা ও অন্তরে নৈতিক মূল্যবোধ প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়। মনের চাহিদা পূরণ নিয়েই সে ব্যস্ত । আত্মার চাহিদার প্রতি তারা উদাসীন। এ দু’য়ের মাঝে একটা বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়।
(গ) এ শিক্ষার অন্যতম পরিণতি হলো বিভাগীয় পৃথকীকরণে অর্থাৎ জ্ঞানকে সমন্বিত করে পূর্ণাঙ্গ এককে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্রগণ ছোট ও অসংগত টুকরোরূপে জগতকে দেখে ও বিভিন্ন টুকরো তথা বিভাগীয় জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হৃদয়ংঙ্গম করতে ব্যর্ত হয়। তারা গাছ দেখে কাঠ দেখে না।
(ঘ) এ শিক্ষা এমন সব লোক সৃষ্টি করে জীবনের মৌলিক ও জরুরী বিষয়গুলোর উপর যাদের সুগভীর পান্ডিত্য থাকে না। বস্ত্তত তাদের জ্ঞান অত্যন্ত অগভীর একে অভিজ্ঞতা লব্ধ গভীর জ্ঞান বলে বিবেচনা করা চলে না। জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ শিক্ষা ইস্পিত ফলোৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়।
১৪. ইসলামী শিক্ষা কিঃ
ইসলামী শিক্ষা বলতে বুঝতে হবে যে শিক্ষার প্রতিটি বিভাগই কুরআন ও হাদীসভিত্তিক, অর্থাৎ যার কোন একটি দিকও ইসলামী আকিদাবিরোধী নয় এমন শিক্ষার নামই হলো ‘ইসলামী শিক্ষা’।
ইসলামের জ্ঞান লাভ করা অর্থাং দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়গুলো একজন মানুষের মুসলিম হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত। এ কারণেই হাদীস শরীফে বলা হয়েছেঃ ‘‘দীনী ইল্ম তলব করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয তথা আবশ্যকীয়।’’ (ইবন মাজাহ ও বাইহাকী শরীফ) অনেকেই হয়তো মনে করেন ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা মানেই হল বিজ্ঞান শিক্ষা না করা, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করা। তারা মনে করে থাকেন ইসলামে মুক্তচিন্তার কোন সুযোগ নেই, অন্ধবিশ্বাসই হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। অথচ এ ধারণাগুলো বাস্তবিকই অবান্তর। আসলে এ ধরনের ধারণাও তৈরি হয়েছে কুরআন-হাদীসকে যথাযথভাবে না জানার কারণেই। কারণ কুরআন কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের কথা বলেনি, আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মানুষকে বাধ্য করার কথাও বলেনি। বরং আল-কুরআনের পরতে পরতে আল্লাহ্র অস্তিত্ব উপলব্ধির জন্য মানুষের বিবেকবোধকেই নাড়া দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার আহবান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে সৃষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে স্রষ্টার নিদর্শন। স্রষ্টার
অস্তিত্ব উপলব্ধির জন্য বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছে। মানুষের বিবেক ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানোর আহবানের মাধ্যমে মূলত: মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। এভাবে আল-কুরআনের পরতে পরতে স্রষ্টার নিদর্শন তুলে ধরার পাশাপাশি বলা হয়েছে- ‘‘দীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। হিদায়াতের পক্ষ থেকে গোমরাহিকে পৃথক করে দেখানো হয়েছে। এখন যে কেউ ‘তাগুত’-কে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনেছে সে এমন একটি মজবুত রজ্জু অবলম্বন করেছে যা কখনও ছিড়ে যাবে না। আর আল্লাহ্ সবকিছু শুনেন ও জানেন।’’ (সূরা আল-বাকারাঃ ২৫৬)
আবার কেউ কেউ হয়তো মনে করেন শুধু কুরআন-হাদীস পড়াই হচ্ছে ইসলামী শিক্ষা। এর বাইরে আর সব শিক্ষাই ইসলাম বিরোধী শিক্ষা। এ ধারণা যে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রসূত তা বলাইবাহুল্য কারণ কুরআন বিজ্ঞান চর্চার জন্য নিরন্তর নির্দেশ দেয়, যার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। শুধু তাই নয় কুরআনই বলে, যারা সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে অর্থাৎ বিজ্ঞান চর্চা করে, তারাই জ্ঞানী সম্প্রদায় এবং এই জ্ঞানী সম্প্রদায়ই আল্লাহ্কে বেশি চিনতে পারে এবং তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে মূলত: জ্ঞানী লোকেরাই। আল-কুরআনে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ
‘তোমাদের মধ্যে যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু সে আল্লাহর নিকট ততবেশী সম্মানিত’। (সূরা আল হুজরাত ৪৯ঃ ১৩)
আল্লাহ্র দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে যারা মানবজাতিকে সৎ পথ দেখাবার জন্য এগিয়ে এসেছেন তারা ইতিহাসের প্রচীনতম যুগ থেকে একই সত্য পেশ করেছেন এবং ভবিষ্যতেও যে ব্যক্তি এ জ্ঞানের উৎস থেকে লাভবান হয়ে কিছু পেশ করবেন তিনিও এ একই পুরনো কথার পুনরাবৃত্তিই করবেন। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল মানুষের মাঝে এক আল্লাহ্র গোলামী করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তিলাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহ্ প্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদেরকে পেশ করার যোগ্যতা অর্জন এবং খিলাফাত পরিচালনা ও মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন। আল-কুরআন মানুষকে ইসলামী শিক্ষার এই ব্যাপক ধারণা দান করতে গিয়ে বলছেঃ
إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِيْنَ
‘এটি হচ্ছে গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য উপদেশ’। (সূরা আত্ তাকবীর ৮১ঃ ২৭)
‘ব্যক্তিদের উপর ইসলাম কতগুলো কর্মসীমা ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, যেন তা সামগ্রিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর না হয়ে ইতিবাচকভাবে তা কল্যাণকর ও সাহায্যকারী হতে পারে।’

১৫. ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলীঃ
১. শিক্ষার্থীদেরকে মানুষ ও এই বিশ্বজগতের সর্বশক্তিমান স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, মালিক, মনিব, শাসক, মা’বুদ, সার্বভৌম ও সর্বময় কর্তৃত্বশীল মহান আল্লাহ্র প্রতি ঈমানদার, আস্থাশীল, অনুগত ও বিনীত করে তোলা তথা তাদেরকে এক আল্লাহ্মুখী করে গড়ে তোলা।
২. শিক্ষার্থীদেরকে রিসালাতে বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা এবং তাদের মাঝে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে মানার ও তাঁকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা সৃষ্টি করা।
৩. শিক্ষার্থীদেরকে পরকালের জীবনের প্রতি বিশ্বাসী করে তোলা এবং তাদের মধ্যে পরকালের সাফল্য ও ব্যর্থতাকেই প্রকৃত সাফল্য ও ব্যর্থতা হিসেবে গ্রহণ করার স্বচ্ছ জ্ঞান ও বোধ সৃষ্টি করা এবং তাদের মধ্যে পরকালের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করা।
৪. আল্লাহ্ প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে শিক্ষার্থীদের দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পূর্ণ বিকাশ সাধন করা।
৫. শিক্ষার্থীদের মধ্যে আল্লাহ্র দাস (আব্দ) ও প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রেরণা ও যোগ্যতা সৃষ্টি করা।
৬. শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র বিবেকবোধ ও বলিষ্ঠ নৈতিক চেতনা জাগ্রত করে দেয়া।
৭. শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মচেতনা, আত্মোপলব্ধি, আত্মসম্মানবোধ ও আত্মপর্যালোচনার ভাবধারা সৃষ্টি করা।
৮. সময় ও সমাজ চাহিদার প্রেক্ষিতে দক্ষ, জীবন ও কর্মমুখী, সৎ, চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বস্ত, উদ্যমী ও সাহসী মানুষ সৃষ্টি করা।
৯. সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যথাযোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা।
১০. শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতাবোধ সৃষ্টি করা এবং তাদের মানবতার কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করা।
১১. জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা।
১২. সময় ও যুগের চাহিদা মাফিক দক্ষ ও যোগ্য গবেষক, আবিষ্কারক, চিন্তাবিদ, লেখক, বিচারক, শিক্ষক, সৈনিক, সমাজকর্মী, প্রশাসক, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি এবং সকল ক্ষেত্র ও বিভাগ পরিচালনার উপযুক্ত লোক তৈরি করা।
১৩. সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর মেধা ও প্রবণতা বিকাশের পূর্ণ সুযোগ নিশ্চিত করা।
১৪. শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকশিত করা, তাদের মধ্যে ইজতেহাদী যোগ্যতা সৃষ্টি করা।
১৫. সৎ, চরিত্রবান, নীতিবান ধার্মিক ও বিবেকবোধ সম্পন্ন নাগরিক তৈরি করা, উৎপাদন ও কর্মমুখী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা।
১৬. আল্লাহ্ প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে জীবন, জগত ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যের মাঝে সমন্বয় সাধনের যোগ্যতা অর্জন, জীবনের গুরুত্ব অর্জন এবং জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন।
১৭. নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জানা এবং তা সংরক্ষণ ও বিকাশের যেগা্যতা ও প্রেরণা লাভ।
১৮. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে নিজস্ব বিশ্বাস ও নীতির আলোকে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা অর্জন করা।
১৬. জ্ঞান শাখার অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্কঃ
ইসলামের সঙ্গে সংস্কৃতি, মনোবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস সহ পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান শাখার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। সংস্কৃতি হলো মানবের আচরণের বিদ্যা। মনোবিজ্ঞান হলো মানব মনস্তত্ত্বের বিদ্যা। দর্শন হলো বস্ত্ত ও ভাববাদী তত্ত্বের বিদ্যা। বস্ত্তর ব্যাপারেও ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ আছে। মন বা আত্মার মাধ্যমেই তো মানুষ মূলত জ্ঞান চর্চা, উন্নতি অথবা স্রষ্টাকে চেনার সাধনা করে থাকে। সে জন্য মনোবিদ্যা ও দর্শন - দুটো বিষয় ইসলামের খুবই মূলীভূত বিষয়। মনোবিদ্যা আবার দর্শনের একটি শাখা। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে সমগ্র মানবজাতিকে একই গোত্রভূক্ত করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। বিভিন্ন দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, ভূগোলের মধ্যে তিনি মানুষকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। (সূরা হুজুরাতঃ ১৩) এই বিষয়টি নৃতত্ত্ব, পরিবেশবিদ্যা, ভূগোল বিষয়ের অন্তর্গত। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে, অবিশ্বসীদের পরিণতি কি হয়েছিল, সভ্যতার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তা অনুধাবন করে না ? এই প্রশ্নের জবাবের মধ্যে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও সভ্যতার জ্ঞান বিশেষভাবে নির্দিষ্ট রয়েছে। আল্লাহ মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন। মহাশূন্যে সব কিছুই ঘূর্ণায়মান। মানুষকে আল্লাহ্ পুঞ্জিভূত রক্তপিন্ড (সূরা আল আলাক, আয়াতঃ ০২) ও বীর্য হতে সৃষ্টি করেছেন - এগুলো আল-কুরআনে রয়েছে। এই বিষয়গুলো জীববিদ্যা, জ্যোতিবিদ্যা ও জেনেটিক সাইন্সের অর্ন্তগত। সেই জন্য এটি স্পষ্ট যে, মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তা‘আলা যেহেতু সমস্ত জ্ঞানের স্রষ্টা; তাই বিশ্বজ্ঞানের সব বিষয়কেই আল্লাহ্ মানুষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। আল্লাহ্ যেহেতু সমস্ত জ্ঞানে জ্ঞানী সেই জন্য ইসলামী জ্ঞানতত্ত্ব সমস্ত জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণকারী। সততা ও আল্লাহ্র উপর বিশ্বাসী থেকে মানব কল্যাণের জন্য নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশিত পথে মানুষ সমগ্র জ্ঞানের সুস্থ ও নৈতিকচর্চা করে যাবে - এটি আল্লাহ্র নির্দেশ মানুষের কাছে।
১৭. জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহঃ
জ্ঞান ইসলামীকরণের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে এখানে ডক্টর ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতামত তুলে ধরা হল।
আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনের অগ্রপথিক হলেন ডক্টর ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী। তাঁর মতে আধুনিক জ্ঞানের ইসলামীকরণ একটি মহান পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে, যদি সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে মুসলিম বিশ্বে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে চালু করা হয়।
জ্ঞানের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি যেসব মতামত দিয়েছেন, তা অতিসংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
প্রথম ধাপঃ আধুনিক জ্ঞান আয়ত্তে এনে এর শাখাগুলোকে শ্রেণী, নীতি, পদ্ধতি, সমস্যা ও বিষয়বস্ত্ত অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপঃ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জরিপ চালিয়ে অর্থাৎ এর উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক বিকাশ, বিকাশের পদ্ধতি, দৃষ্টিপাতের ব্যাপকতা এবং এর পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবদানের উপর আলোকপাত করতে হবে।
তৃতীয় ধাপঃ জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সাথে ইসলামের বিস্তৃত সামঞ্জস্য অন্বেষণের আগেই ঐ বিষয় সম্পর্কে ইসলামী জ্ঞান কি বলতে চায় তা উদঘাটন করা আবশ্যক অর্থাৎ পন্ডিত্ব আর্জন করতে হবে।
চতুর্থ ধাপঃ ইসলামী জ্ঞানের বিশ্লেষণকল্পে ইসলামী চিন্তাবিদদেরকে বর্তমান সমস্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্ত্তত করে ক্রমবিন্যাস করতে হবে।
পঞ্চম ধাপঃ এখন জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ের সাথে ইসলামী জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিকতা উভয়ের অভিন্ন অবদানের আলোকে নির্ণয় করতে হবে।
ষষ্ঠ ধাপঃ এ পর্যায়ে আধুনিক জ্ঞানকে ইসলামের দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।
সপ্তম ধাপঃ ইসলামী জ্ঞানের উৎস পর্যালোচনা করতে হবে আল-কুরআন ও আল-হাদিস এর সুস্পষ্ট দৃষ্টান্তের আলোকে, বিশ্বব্যাপী উম্মাহর বর্তমান চাহিদা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান এর ভিত্তিতে।
অষ্টম ধাপঃ উম্মাহর প্রধান সমস্যাবলী কারণ ও লক্ষণসহ জরিপ করতে হবে।
নবম ধাপঃ যেহেতু সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের দায়িত্ব ইসলামী দর্শনের উপর ন্যাস্ত সেহেতু আজকের বিশ্বের সমস্যা সমাধানে মানব জাতির সমস্যা জরিপ করতে হবে।
দশম ধাপঃ সর্বোচ্চ বিচক্ষণতার সাথে সৃজনশীল বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করতে হবে।
একাদশ ধাপঃ ইসলামী কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের পুনর্বিন্যাস এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনা যা জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপ হিসাবে পরিগণিত।
দ্বাদশ ধাপঃ ইসলামী জ্ঞানের প্রসারের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকগুলো বিভিন্ন দেশের স্ব স্ব ভাষায় মুদ্রিত করে সংশ্লিষ্ট সরকার গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাতে হবে।
১৮. জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে সমস্যা ও সম্ভাবনাঃ
জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে যা নিম্নে পর্যায়ক্রমিকভাবে দেখানো হলঃ
এক. বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থাঃ
জ্ঞানের ইসলামীকরণের পথে একটি প্রকট সমস্যা হচ্ছে দ্বি-মুখী শিক্ষাব্যবস্থা। একমুখী শিক্ষা হলে দ্রুত সংস্কার করা যেত। দ্বি-মুখী বা বহুমুখী শিক্ষার কারণে সমাজের অধিবাসীদের মধ্যে চিন্তা-চেতনার ফারাক শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষায় পশ্চিমা জ্ঞান বিজ্ঞান কোন বাছ বিচার না করেই গ্রহণ করা হচ্ছে। পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা হয়, বিভিন্নমুখী শিক্ষার ফলে জ্ঞানের প্রতি বিভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী লালন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুই. দীর্ঘকালের স্থবিরতাঃ
দীর্ঘকালের স্থবিরতার কারণে মুসলিমরা চিন্তা-চেতনায় ইসলামী জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন অ-ইসলামী জ্ঞানই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক চিন্তাভাবনার প্রতি মুসলিম যুব সমাজ ঝুঁকে পড়েছে আধুনিকতার চাকচিক্যে।
তিন. চাকুরি বা কর্মক্ষেত্রের দৈন্যতাঃ
ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চায় চাকুরি নেই। আদর্শিক জীবন গঠনে ধর্মীয় জ্ঞানের অবদান থাকলেও তার প্রতি অবহেলা করা হয়। এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানের মাঝে নিহিত বৈষয়িক ব্যবস্থা থাকলেও জীবনে কার্যকর করা হচ্ছে না। কারণ সেসব নৈতিকতা পূর্ণ। তাই উপনিবেশিক আমল থেকে দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসনের অধীনে গড়ে উঠা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামী জ্ঞানের আলোকে চাকুরির ক্ষেত্র নিরূপিত না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে দিনদিন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চার. মুসলিম নেতৃবৃন্দের উদ্যোগের অভাবঃ
মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইসলামের কার্যকলাপের প্রতি খুব একটা উদ্যোগী নয়। তাঁদের কার্যকলাপ পরিকল্পনা ভিত্তিক না হয়ে অধিকাংশ সময়ে আবেগতাড়িত বা অন্ধ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হন। জ্ঞান ইসলামীকরণে তেমন উদ্যোগ নেন না বা এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করেন না।
পাঁচ. আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানের অভাবঃ
মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের প্রভাবে ধর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ পশ্চিমাদের জ্ঞানের মূল উৎস ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে মুসলিমদের ধারণা থাকলে তারা সে ধরনের চেতনায় প্রভাবিত হতো না।
ছয়. মিডিয়ায় মুসলিমদের আধিপত্যের অভাবঃ
সমগ্র বিশ্বে দ্রুত তথ্য পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়া যথা- টিভি, স্যাটেলাইট, মোবাইল, রেডিও, ইন্টারনেট, পত্রিকা ইত্যাদি শক্তিশালী মিডিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে। মিডিয়ায় ইসলাম বিরোধী ইয়াহুদী ব্লক সহ পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকা, ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে মুসলিমদের সম্পর্কে যে কোন বানোয়াট তথ্য মুহুর্তে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌঁছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে মুসলিমদের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। ইসলামী জ্ঞানের প্রতি বিশ্বজনমত বিষিয়ে তোলা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যাচার করে। এটিও একটি বড় সমস্যা।
সাত. পর্যাপ্ত উপকরণের অভাবঃ
ইসলামের আলোকে জ্ঞানতত্ত্বের উপর বইয়ের অভাব রয়েছে। জ্ঞানকে কিভাবে ইসামীকরণ করা যাবে, তার উপর সহজ সাবলীল গ্রন্থ বাজারে তেমনটি নেই। এ বিষয়টি এখনো বিশেষজ্ঞদের কাজ বলে প্রচলিত। সাধারণ শিক্ষিতদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে এর অবস্থান হওয়ার কারণে এটি মুসলিম সমাজকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করতে পারছে না। এছাড়া, এ বিষয়ে পত্র পত্রিকা ও জার্নালের অভাব রয়েছে। যে জন্য উন্নয়নকৃত ধারণাগুলো দ্বারা সহজে উপকৃত হওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে উপকরণসমূহের অভাব রয়েছে এবং যা আছে, তাও দুস্প্রাপ্য। এছাড়া জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রচিত বইয়ের সংখ্যা একান্তই নগণ্য।
আট. উন্নত ক্যারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাবঃ
জ্ঞান ইসলামীকরণের আলোকে উন্নত ক্যারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে শুধু মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোন স্কুল বা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর করার মতো পূর্ণাঙ্গ ক্যারিকুলাম ও সিলেবাস নেই। মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েও চাকুরির বাজারের কথা চিন্তা করে ইসলামীকরণের আলোকে সিলেবাস ও ক্যারিকুলাম কার্যকর করা থেকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে আসছে।
নয়. মুসলিমদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভাবঃ
মুসলিম সমাজের মূল সূত্র হচ্ছে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ। কিন্তু বর্তমানে এক্ষেত্রেই সংকট বিরাজমান। যেজন্য ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেও অনৈক্যের কারণে উদ্যোগ সমূহ যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। মুসলিম সমাজের বাস্তবতার আলোকে তাদের জ্ঞান ও শিক্ষা কাঠামো ও বিন্যাস কি ধরনের হবে এ ব্যাপারে আজোবধি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।
দশ. ইসলামী চেতনার অভাবঃ
মুসলিম সমাজে কাঙ্খিত চেতনার অভাব রয়েছে। মুসলিম উম্মাহ নিজেদের ঈমান ও স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি মুসলিমের ঘরে জন্ম নিয়েও ইসলামীকরণের বিরোধিতা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
এগার. ইসলাম বিরোধী চক্রান্তঃ
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সতত মুসলিমদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। তাদের ক্রীড়নক হয়ে অনেক বিভ্রান্ত মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবি জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের যৌথ নীলনক্সার সামনে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগসমূহ ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
বার. অর্থনৈতিক সংকটঃ
এক সময় আরব বিশ্বের পেট্রো ডলারে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনটি সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সন্ত্রাসের অপবাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থ সম্পদ আমেরিকা ও ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ আটকিয়ে দিচ্ছে। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সরকার ও জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে সেসব প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন না করার জন্য এবং সঞ্চালন না করার জন্য। জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রতিষ্ঠানসমূহ বর্তমানে এ সমস্যার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মোটকথাঃ জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি ইসলামী দাওয়াতী কাজের অংশ। তাই ইসলামী দাওয়াতকে ঠেকাতে যেয়ে ইসলাম বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ পথে বিভিন্ন বাঁধা সৃষ্টি করেছে। যে কারণে বিভিন্ন দিক দিয়ে জ্ঞান ইসলামীকরণ তৎপরতাটিও আক্রান্ত হচ্ছে।
সম্ভাবনাগুলোঃ
এতকিছুর পরও এক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনাও বিশাল, যা নিম্নে দেখানো হলঃ
একঃ ইসলাম সম্পর্কে মুসলিমগণ নিকট অতীত থেকে একটু বেশি সচেতন। তাদের এ সচেতনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুইঃ ইসলামের প্রতি ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াবাসী অমুসলিমদের আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনঃ জ্ঞান ইসলামীকরণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। অতীতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দেখা যায় নি।
চারঃ এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাধর্মী জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে।
পাঁচঃ এ বিষয়ে গবেষণায় ক্রমেই বুদ্ধিজীবিমহলে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সাথে এ বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।
ছয়ঃ জ্ঞানের জগতে পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
সাতঃ পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় মুসলিমরাও কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের মডেল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে যা জ্ঞান ইসলামীকরণের পথকে সুগম করছে।
আটঃ বিশ্বে অনেক মুসলিম দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে বিন্যাস করতে চাইছে এবং এ লক্ষ্যে নতুন নতুন চাকুরির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে যা জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে একটি ইতিবাচক দিক।
এতসব আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান যে জ্ঞান ইসলামীকরণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের সবকিছু বিনা বিচারে গ্রহণ করা সঠিক পদ্ধতি নয়। তাদের নির্দিষ্ট দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সেভাবেই তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিন্যাস করছে। তাই এটা ইসলামী সমাজ দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই মিল না থাকলে বিপর্যয় দেখা দেবে। যেমনঃ রক্তের গ্রুপ না মিলিয়ে রক্ত পুশ করলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। তাই মেচিং এর গুরুত্ব আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়েরই ইসলামীকরণ প্রয়োজন। শুধু জ্ঞান ইসলামীকরণই যথেষ্ট নয়। কারণ জ্ঞান বিতরণ প্রক্রিয়াটি যদি ইসলামীকরণ না হয়, তাহলে জ্ঞান যথাযথভাবে উপস্থাপিত না হয়ে বিকৃত আকারেও উপস্থাপিত হতে পারে।
১৯. সমন্বিত জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাঃ
শিক্ষার আরেকটি নীতি হচ্ছে যে, ছাত্রদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ ও সমন্বিত জ্ঞান প্রদান করতে হবে। তাদের উচিত বিশ্বের দৃশ্যমান বিষয়সমূহের বিভিন্নতা মাঝে বিশ্বের ও জীবনের অদ্বিতীয়ত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হওয়া।
The Report of the Education Commission of India বিবৃত করছেঃ ‘‘পাশ্চাত্য ও প্রচ্যের পন্ডিত ব্যক্তিদের মতে সর্ববিধ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের একটি সুসংগত নকশা এবং একটি সমন্বিত জীবন পদ্ধতি প্রদান। এর মাধ্যমে আমাদেরকে পেতে হবে পরিপ্রেক্ষিতের অনুভূতি, সংক্ষিপ্তাকারের পরিজ্ঞান এবং জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়। অসংলগ্ন কতগুলো তথ্য অবলম্বন করে মানুষ বাঁচতে পারে না। সব জিনিসের সামঞ্জস্য উপলব্ধির একটি সংহত বুদ্ধিবৃত্তিক পরিজ্ঞানের কামনা প্রতিটি মানুষের মাঝে নিহিত আছে। বিচিত্র অভিব্যক্তির মূলে জীবন অদ্বিতীয়। বিভিন্ন তথ্যপূর্ণ সম্পর্ক সম্বন্ধে আমরা পড়তে পারি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জীবন সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে।’’
ইসলাম মাঝামাঝি পথের পক্ষে। এর আদর্শ হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী অনুযায়ী চিন্তা ও আচরণের ভারসাম্য নবুওয়াতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিক্ষাকে তাই এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে রাখতে হবে যেন একজন ছাত্র জ্ঞানের ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত লাভ করতে পারে এবং বিশিষ্টকরণের (Specialization) স্তরে প্রবেশ করার আগে জীবন ও সমস্যাবলীর প্রতি সুসংহত দৃষ্টিকোণ অর্জন করতে পারে।
তাছাড়া ইসলাম জ্ঞানকে সমন্বিত ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সামগ্রিকতা বলেই বিবেচনা করে। একথার সত্যতা এখান থেকে নেয়া যায় যে, আল-কুরআন-ই হচ্ছে সব জ্ঞানের প্রধান উৎস। এ গ্রন্থটিই যে কোন বিভাগীয় জ্ঞানান্বেষণকারীর মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ন্ত্রণ করবে। এ বাস্তবতা আমাদেরকে সয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বিত জ্ঞানের ধারণার দিকে পরিচালিত করছে। জ্ঞান ক্ষুদ্র ও অসংলগ্ন ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত থাকবে না। কিন্তু তা হবে সমন্বিত। একটি মাত্র এককে সম্পৃক্ত। এভাবেই তিরোহিত হবে জ্ঞানকে ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করা এবং বিভাগীয়রূপে ভাগ করে নেয়ার পদ্ধতি। হয়তো এটাই হবে উচ্চতর পর্যায়ে বিশিষ্টকরণ সূচীত করার পথে সামিল। নিম্নস্তরসমূহে শিক্ষা সমন্বিত থাকা উচিত। এ পদ্ধতির শিক্ষাই যুবকদের দৃষ্টিভঙ্গীর সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হবে এবং তাদের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতার গুণ কর্ষণ করবে।
২০. শিক্ষা ইসলামীকরণের লক্ষ্যে সুপারিশমালাঃ
সর্বপ্রথমে সংবিধানের মূলনীতির আলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণের দৃঢ় আঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে মক্কা ঘোষণার শিক্ষা বিষয়ক মূলনীতির সাথে ঐক্যমত পোষণকারী ও ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিশন গঠন করতে হবে। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের ধর্মীয় শিক্ষার সঠিক মূল্যায়নের জন্য স্ব-স্ব ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিবর্গকে কমিশনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে দূরদর্শী ও বাস্তবধর্মী জাতীয় আদর্শ, ঐতিহ্য, চিন্তা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রেখে দীর্ঘমেয়াদী একক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, শরী‘আ আইনে পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই রাষ্ট্রে চালু শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করবে। তবে ইসলাম ধর্মীয় বই-পুস্তকাদি পড়তে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে না। দেশের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা তাদের নিজেদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের থাকবে।
প্রতিটি মাসজিদ, মক্তব, হিফযখানা, টোল প্রভৃতি সকল স্তরে ইবতেদায়ী ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে। মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষার স্তরে বিভিন্ন ধর্মের তূলনামূলক অধ্যায়নের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে শিক্ষার সকল স্তরে প্রবর্তনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এটি কার্যকর করার জন্য মুসলিম ছাড়াও হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধ সকল ধর্মের নিষ্ঠাবান ধার্মিক জ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে। রেডিও টেলিভিশনসহ সকল প্রচার মাধ্যমকে নিছক অশ্লীল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জাতীয় মূল্যবোধ, আদর্শ, ঐতিহ্য, চেতনা, শিক্ষা বিস্তার ও নৈতিক মূল্যবোধ উজ্জীবিত করার মত শিক্ষামূলক জ্ঞান বিতরণ ও চরিত্র গঠনের উপযোগী অনুষ্ঠান প্রচারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যেহেতু জ্ঞানের মূল উৎস আল-কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ ও সংরক্ষিত হয়েছে, তাই আরবী ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষাদান করতে হবে। সকল বিভাগের ছাত্রদেরকে ইসলামের মৌলিক ইবাদাতসমূহ অনুশীলন করে শেখাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা থাকবে পাশাপাশি। ছাত্রদের স্বাধীনতা রক্ষার সৈনিক, আদর্শের প্রচারক ও সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষানীতি হবে ইসলামী সংস্কৃতির উৎসস্থল। শিক্ষার সকল স্তরে ও সকল বিভাগে ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
শিক্ষার্থীকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ইসলামী আদর্শের আলোকে জীবন পরিচালনা করতে পারে। এই উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের আলোকে পরিচালিত হবে। এই জন্য প্রয়োজন সমগ্র কারিকুলামের সংস্কার, নতুন টেক্সটবই প্রস্ত্ততকরণ এবং ইসলামী দৃষ্টিকোণের আলোকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রতিটি বিষয়, বিশেষত সামাজিক বিজ্ঞান-এর শিক্ষণ কার্যক্রমে ইসলামী দৃষ্টিকোণের ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, এবং প্রতিটি ধাপেই শিক্ষার্থীর মাঝে নৈতিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার জন্য যথাযথ যত্মবান হতে হবে।
মুসলিম সম্প্রদায় একটি ধর্মতত্ত্ব এবং একটি দৃঢ় বিশ্বাসের মূল্যাবোধ এর উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে যা তার সদস্যদের দিয়েছে সঞ্জীবিত চরিত্র এবং স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বর্তমানে মুসলিমগণ হয়ে আছে স্থবির কিন্তু ইসলাম তার চিরস্থায়ী গুণাবলী বজায় রেখে সত্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। উম্মাহর প্রতি শিক্ষার দায়িত্ব শুধু এই সংক্ষিপ্ত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকা নয় বরং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
২০.১. শিক্ষার মাধ্যমঃ
প্রাথমিক স্তর (প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী) পর্যন্ত শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো সর্বাধিক বোধগম্যকরণে মাতৃভাষা ‘বাংলা’ থাকবে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে।
ইসলাম কোন নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং পৃথিবীব্যাপী মুসলিমরা আজ বিস্তৃত যাদের মুখের ভাষা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে বিভিন্ন হলেও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজীর মাধ্যমে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ও.আই.সি)-র দ্বারা যোগাযোগ সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে। তাই বৃহত্তর মুসলিম জাতীয়তাবাদকে অধিক পরিমাণ উদ্দীপিত করতে এবং আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিযোগীতাপূর্ণ চাকুরির বাজারে মুসলিম নতুন প্রজন্ম নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আন্তর্জাতিক ভাষা ‘ইংরেজী’ বাধ্যতামূলক থাকবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, যেহেতু সমস্ত প্রজ্ঞা জ্ঞানের উৎস ভান্ডার আল-কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে সেহেতু আল-কুরআন বুঝে তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য ‘বাংলা’ ও ‘ইংরেজী’-র পাশাপাশি ‘আরবী’ ভাষাকে গ্রেজুয়েশন পর্যায় (বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন অনুসদের প্রস্তাবিত প্রোগ্রামের সাথে আন্ডার গ্রেজুয়েট পর্যন্ত বাধ্যতামূলক থাকবে) পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২০.২. স্তরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা (প্রাক-প্রাথমিক-গ্রেজুয়েশন পর্যায়)ঃ
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে জীবনের সকল ক্ষেত্রে, বিশেষতঃ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে ও ধাপে ধাপে শিক্ষার কথা বলেছেন। তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও ধাপে ধাপে বিন্যস্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ০৩ টি স্তরে বিন্যস্ত থাকবে। যেমনঃ (ক) প্রাথমিক, (খ) মাধ্যমিক, (গ) ও গ্রেজুয়েশন পর্যায়। নিম্নে প্রত্যেকটি স্তরের প্রস্তাবিত শিক্ষা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ
২০.২.১. প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাঃ
শিশুদেরকে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশব্যাপী গ্রামভিত্তিক বা মাসজিদ- কেন্দ্রিক আদর্শ ফোরকানিয়া মক্তব চালু করতে হবে। এসব মক্তবে ১ থেকে ১.৫ ঘন্টা সময় ধরে শিশুরা আল-কুরআন সহীহ্ ভাবে তিলাওয়াত শিখবে ও শরী‘আতের প্রাথমিক আহ্কাম জানার সুযোগ পাবে।
২০.২.২. প্রাথমিক শিক্ষা (১ম শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী) ঃ
১. প্রাথমিক স্তরে বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে প্রয়োজনীয় সংশোধন সাপেক্ষে স্কুলগুলোতে যা পড়ানো হয় তার প্রায় সবই পড়ান যেতে পারে, কিন্তু পাঁচটি জিনিস সব পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে।
ক) শিশুমনে এ কথা বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে এ দুনিয়া আল্লাহ্র সাম্রাজ্য। মানবজাতি আল্লাহ্র প্রতিনিধি। এ কথা শিশু মনে ইসলামী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা জন্মাতে হবে।
খ) ইসলাম যে সব নৈতিক ধ্যান-ধারণা ও মূল্যাবোধ পেশ করে তা প্রত্যেক বিষয়ের পাঠ দেয়ার সময় এমনকি অংকের প্রশ্নমালার ভিতর দিয়েও শিশুর মনে বদ্ধমূল করতে হবে।
গ) এ সময়েই শিশুমনে ইসলামের জ্ঞান, আকীদা ও ঈমানের বিষয়গুলো বদ্ধমূল করে দিতে হবে। এ কাজ প্রয়োজন বোধে প্রাথমিক ভাবে ইসলামিয়াত নামের বইয়ের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। স্মরণ রাখতে হবে ঈমান-আকীদার বিষয়গুলো অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যেও এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যেমন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রাণ প্রবাহ ছড়ান থাকে।
ঘ) শিশুকে ইসলামী জীবন-প্রণালী শেখাতে হবে- যেমন পাক-পবিত্র হওয়ার নিয়ম কানুন, অযুর মাসলা-মাসায়েল, নামায-রোযার নিয়ম, হালাল-হারামের সীমা, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর হক, পানাহারের নিয়ম-কানুন, পোশাক-পরিচ্ছদ সংক্রান্ত বিধান ইত্যাদি।
ঙ) তাজবিদসহ সহীহ্ করে কুরআন তিলাওয়াত করার যোগ্যতা যাতে সৃষ্টি হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষাকে সাধারণ প্রাথমিক শিক্ষার সমমান সম্পন্ন করতে হবে।
৩. প্রাথমিক শিক্ষা আট (৮) বছর মেয়াদী হতে পারে। পাশাপাশি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষাও আট (৮) বছর মেয়াদী হতে হবে। তবে দু’টি ধারাকে একত্রিত করে একমুখী ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা গেলে তা একই ইসলামী মনোভাব সম্পন্ন নতুন প্রজন্ম তৈরীর লক্ষ্য অর্জনে অধিক ফলপ্রসূ হবে।
২০.২.৩. মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা (৯ম শ্রেণী থেকে ১২তম শ্রেণী)ঃ
(ক) আকায়িদঃ এ পর্যায়ে এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় জটিলতার নিরস বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বরং ঈমানিয়াত সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীর হৃদয়ঙ্গম করাতে হবে যা স্বাভাবিক অনুভূতি ও বুদ্ধি-বিবেকের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে।
(খ) ইসলামী আখলাকঃ এ বিষয়টি শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে কেবল নৈতিকতার তাত্ত্বিক ধারণা পেশ করলে চলবে না। বরং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরামের বাস্তব জীবন থেকে এমন কিছু ঘটনা নির্বাচিত করে তুলে ধরতে হবে, যা দ্বারা শিক্ষার্থী একজন মুসলিমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কি এবং এক জন মুসলিমের জীবন কেমন তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
(গ) ফিকাহ্ শাস্ত্রীয় বিধিমালাঃ এ বিষয়টি শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামনে বান্দার হক, আল্লাহ্র হক এবং ব্যক্তি জীবনের আচরণ সম্পর্কে ইসলামী আইনের এমন কিছু প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় আহ্কাম তুলে ধরতে হবে যা জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য।
(ঘ) ইসলামী ইতিহাসঃ এ পর্যায়ে ইসলামী ইতিহাস শিক্ষাদানের পরিসর রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন চরিত্র ও সাহাবায়ে কিরামের যুগ পর্যন্ত সীমিত থাকবে।
(ঙ) আরবীঃ এ পর্যায়ে আরবী ভাষার নিছক প্রাথমিক জ্ঞান দান করতে হবে যা আরবী সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
(চ) আল-কুরআনঃ কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে এ স্তরে এতটুকু জ্ঞান দান করতে হবে যাতে শিক্ষার্থী কুরআন শরীফ দেখে ভালভাবে পড়তে পারে। সহজ সরল যাতে আয়াতগুলোকে কিছুটা বুঝতে পারে এবং কয়েকটা সূরা মুখস্থও করে নিতে পারে।
২০.২.৪. কলেজ স্তরের শিক্ষা (গ্রেজুয়েশন পর্যায়) ঃ
কলেজ স্তরে শিক্ষাদনের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ পাঠ্যসূচী থাকবে যা সব শিক্ষার্থীকে পড়ানো হবে। এই পাঠ্যসূচীতে নিম্ন বর্ণিত বিষয়গুলো থাকবেঃ
(ক) আরবীঃ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে আরবি সাহিত্য সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দান করতে হবে। কিন্তু বি.এ. বা স্নাতক পর্যায়ে গিয়ে এ বিষয়টাকে কুরআন শিক্ষার সাথে একীভূত করে নিতে হবে।
(খ) আল-কুরআনঃ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থীকে কুরআন বুঝার জন্য প্রস্ত্তত করতে হবে। বি.এ স্তরের মূল কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা পদ্ধতি হবে এমন যাতে শিক্ষার্থীরা নিজে নিজেই কুরআন মাজিদ পড়ে বুঝতে চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শুধু জটিল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে বুঝাবেন, প্রশ্নের জবাব দিবেন এবং সন্দেহ নিরসন করবেন।
(গ) ইসলামী শিক্ষাঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রের শিক্ষার্থীদেরকে গোটা ইসলামী জীবন বিধান সম্পর্কেই অবহিত করাতে হবে। কি কি মৌলিক ধ্যান ধারণার উপর ইসলামের বুনিয়াদ রচিত হয়েছে সে সব ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে ইসলাম আখলাক ও চরিত্র কিভাবে গঠন করে এবং এর অধীনে সমাজ জীবনে লেনদেন, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং আন্তজার্তিক সম্পর্ককে কোন্ নীতিমালা অনুসারে বিন্যস্ত করে, তা অনুধাবন করাতে হবে। সাধারণ বাধ্যতামূলক বিষয়গুলো ছাড়াও ইসলামী বিষয়গুলোকে ভাগ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞ তৈরির কোর্সসমূহে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং প্রত্যেক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল ইসলামী বিষয়কে তার অঙ্গীভূত করতে হবে।
২০.২.৫. বিশেষ পাঠক্রমঃ
ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ বিভাগগুলোকে আলাদাভাবে শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। এর প্রত্যেকটিকে একই ধরনের পাশ্চাত্য বিষয়ের শেষ পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া উচিত যেমন ‘‘ইসলামী দর্শন’’ ইসলামী দার্শনিক চিন্তধারা বিকাশে মুসলিমদের অবদান এবং ইসলামী হিকমাতকে দর্শন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী ইতিহাস দর্শনকে ইতিহাস বিভাগে, ইসলামী আইনের মূলনীতি এবং ফিকাহ্ শাস্ত্রের ব্যবহারিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ সমূহকে আইন বিভাগে, ইসলামী অর্থনীতির মূলূনীতিসমূহ ও অর্থনীতি লেনদেন সংক্রান্ত ফিকাহ শাস্ত্রীয় অধ্যায় সমূহকে অর্থনীতি বিভাগে এবং ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদ সমূহ, ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস এবং দুনিয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশে ইসলামের অবদানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অন্যান্য বিষয়ও একইভাবে পাশ্চাত্য বিষয়ে অন্তুর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
২০.২.৬. গবেষণা ও ডক্টরেট বিভাগঃ
এই পাঠ্যক্রমের পর ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর গবেষণার জন্য একটা বিশেষ বিভাগ থাকা উচিত। এ বিভাগ থেকে পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেরে মত উচ্চতর তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ বিভাগ থেকে তৈরি হবে এমন সব লোক যারা জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে মৌলিক ও স্বাধীন প্রক্রিয়া অনুসরণের ট্রেনিং লাভ করবে অতঃপর তারা শুধু মুসলিম নয় বরং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তারা দুনিয়ার তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
২০.৩. নারী শিক্ষাঃ
নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ছাত্রীবেতন মওকুফ করতে হবে। ছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। উপযুক্ত মান ও মেধা সাপেক্ষে শিক্ষার সকল শাখায় নারীদের যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাঙ্গন গড়ে তোলার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক স্তরে সহশিক্ষার অবসান ঘটাতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে ছাত্রীদের জন্য আলাদা সিফট চালু করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকতায় নারীদের অধিক হারে নিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সাপেক্ষে উচ্চতর পর্যায়েও শিক্ষকতায় নারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নারী শিক্ষার্থীদেরকে নারী শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীদের জন্য গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, শিশু পরিচর্যা, আত্মরক্ষামূলক শারীরিক শিক্ষা, নারী অধিকার সংক্রান্ত আইন ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি বাধ্যতামূলক থাকবে। প্রকৃতিগত কারণেই নারীদের শিক্ষার মধ্যে এমন উপাদান থাকতে হবে, যা আদর্শ মা হওয়ার পক্ষে সহায়ক হয়।
২০.৪. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকঃ
 উপরিউক্ত সুপারিশসমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই শিক্ষাক্রম তৈরি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
 বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি, তথ্য-বিপ্লব, বিশ্বব্যাপী লব্ধ নব নব জ্ঞান, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মন-মানস ও ধর্ম বিশ্বাস ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।
 বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনমানস ও ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী কোন বিষয় কোন স্তরের কোন পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না।
২১. উপসংহারঃ
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যেখানে ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক সকল বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। এমন কোন বিষয় বাদ নেই যা সম্পর্কে ইসলাম নির্দেশনা প্রদান করেনি। আমরা যদি ইসলামের নিয়ম-কানুন মুতাবিক জীবন পরিচালিত করি তাহলে সকল প্রকার অকল্যান থেকে নিরাপদ থাকতে পারি। আর ইসলামের নবী খাতামান্নাবীঈন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ জীবনে সব বিষয়ে আমল করে দেখিয়ে গেছেন কিভাবে তা পালন করতে হয়। ইসলাম জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। পবিত্র কুরআনের অবতীর্ণ প্রথম আয়তটিই ছিল শিক্ষা সংক্রান্ত। এখানে আললাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ
اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ
অর্থঃ পড়ুন সেই প্রভুর নামে যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আল-আলাক ঃ ১)
মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে কুরআনই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। এ শিক্ষা এ অনুভূতি মানুষকে জীবনে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে। দেশ ও জাতির কোন দায়িত্ব পালনে সে নিষ্ঠাবান হবে এবং সে জীবনের সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও সৎ নাগরিকের পরিচয় দেবে। সমাজের প্রচলিত অন্যায়, দুর্নীতি, অশ্লীলতা থেকে নিজেকে সে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
সত্যিকার মুসলিম আসলে জীবন বিমুখ হতে পারে না, জ্ঞান-পিপাসার ব্যাপারে নিস্পৃহ হতে পারে না, অজ্ঞানতা ও গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। এ বিষয়টিকে আরো ভালভাবে উপলব্ধি করার জন্য আমরা আল-কুরআনের সেই আয়াতটির দিকে ফিরে যেতে পারি যেখানে বিশ্বকে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম উম্মাহ্র গুণাবলীর কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, তাদেরকে হতে হবে ‘শ্রেষ্ঠজাতি’। আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে থেকে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা যে চিন্তা করা যায় না তা বলাইবাহুল্য। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিই হচ্ছে সভ্যতার সকলক্ষেত্রে উন্নতির পূর্বশর্ত। এ কারণে ইসলামে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার উপর যে কত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা মহাগ্রন্থ আল কুরআন না পড়লে বুঝা যাবে না।
আল-কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ আসমানী কিতাব যা যাবতীয় প্রজ্ঞা জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উৎসস্থল। ‘আল-কুরআন ও সুন্নাহ্র সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের কোন সংঘাত বা বিরোধ নেই।’ বরং আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের গভীরতার মধ্যে আমরা এই পৃথিবীর সমস্ত সমস্যর বৈজ্ঞানিক সমাধান খুজে পাই। যেমনঃ আধুনিক বিজ্ঞান অনেক গবেষণার পর মাত্র কয়েক বছর আগে বলেছে, প্রাণের উৎস জলীয়। অথচ প্রায় সাড়ে ১৪ শত বৎসর আগে আল-কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেনঃ ‘‘অবিশ্বাসীরা কি লক্ষ্য করে না যে, আসমান ও যমিন মিলিত অবস্থায় ছিল, তারপর আমি তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি আর পানি থেকে প্রত্যেক জীবন্ত জিনিস সৃষ্টি করেছি; তারা কি বিশ্বাস করবে না ?’’ (সূরা আম্বিয়াঃ ৩০) আবার ‘পদার্থ সম্পর্কে বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত পদার্থের মূলে আছে বিদ্যুৎ, অর্থাৎ আকাশ-পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা মূলত আর কিছুই নয় বিদ্যুতেরই লীলাখেলা। আর এক্ষেত্রে কুরআন বলছে : আকাশ-পৃথিবীর সমস্ত কিছুই আল্লাহ্র নূর হতে সৃষ্টি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কুরআন যা বলছে, আজকের আধুনিক বিজ্ঞান ঠিক সেই কথাই বলছে। বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত পদার্থের মূলে যে বিদ্যুৎ আছে তা দুই প্রকারের- ইলেকট্রনস্ (Electrons) এবং প্রোটনস্ (Protons)। ইলেকট্রন হচ্ছে ঋণাত্মক (Negative) বিদ্যুৎ আর প্রোটন্স হচ্ছে ধনাত্মক (Positive) বিদ্যুৎ। তাদেরকে পুরুষ ও স্ত্রী বিদ্যুৎ বলা যায়। এ থেকে স্পষ্টই আমরা দেখতে পাচ্ছি সৃষ্টির কোন কিছুই একাকী পড়ে নাই। প্রত্যেক বস্ত্তই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক এ কথার সাথে কুরআনের আয়াত মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় : ‘‘সেই আল্লাহ্র মহিমা যিনি পৃথিবীতে যা উৎপন্ন হয়, সেসব বস্ত্তর এবং তদ্রুপ অন্যান্য বস্ত্তর এবং যা তারা (মানুষ) জানে না, এমন বস্ত্তর প্রত্যেকটিকেই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।’’ (সূরা ইয়া-সীন : ৩৬) বিজ্ঞান বলছে : সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র মহাশূন্যের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কোনস্থানে স্থির হয়ে নেই। আর কুরআন বলছে : ‘‘সূর্য চাঁদকে ধরতে পারে না, রাত্রি দিনের নাগাল পায় না, সকলেই মহাশূন্যের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’ (সূরা ইয়া-সীন : ৪০)’
সুতরাং আল-কুরআনের বাণী থেকে এটিই প্রতিয়মান যে, ‘মানুষের জন্য ইসলামই একমাত্র সঠিক জীবনব্যবস্থা কারণ এটাই প্রকৃত তত্ত্ব ও আসল সত্যের অনুরূপ।’ কাজেই এই বিজ্ঞানময় মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষার কোন বিকল্প মানব জীবনে প্রতিষ্ঠিত নেই। তাই আমাদের মুসলিম নতুন প্রজন্মকে আল-কুরআনের সূরা ফাতিহায় বর্ণিত সিরাতুলমুস্তাকিমের পথে দিকনির্দেশনা দিতে একটি নৈতিকতাপূর্ণ যুগোপযোগী ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী।

--০--

 

 

ফুটনোটঃ

 

. Education, http://en.wikipedia.org/WiKi/Education
. শিক্ষা-উইকিপিডিয়া, http://bn.wikipedia.org/WiKi/শিক্ষা
. অধ্যাপক গোলাম আযম, শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা, কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড, মুদ্রনঃ এপ্রিল ২০১০, ঢাকা, পৃষ্ঠা ০৯।
. মানুষ গড়তে ইসলামী শিক্ষা, http://sodeshbangla.wordpress.com
. জামি‘আত তিরমিযী, হাদীস নং - ২৬৮৩।
. অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, রাসূলুল্লাহ্র (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিআইসি, প্রকাশঃ মে ২০১১, পৃষ্ঠা - ১৫-১৬।
. সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং - ৭১, পৃষ্ঠা - ৫৮।
. মানুষ গড়তে ইসলামী শিক্ষা, http://sodeshbangla.wordpress.com
. ফুয়াদ আবদুল হামীদ আল খতীব, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, পঞ্চম প্রকাশঃ অগাস্ট, ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৩
. সৈয়দ মাহবুব হাসান আমিরী, শিক্ষা, শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মৌলিক শিক্ষার গুরুত্ব; সূত্রঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/amiree/29606657
. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী, প্রকাশঃ এপ্রিল, ২০০৭, পৃষ্ঠা-১০
. মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামের দাবী, প্রকাশঃ মে-২০১১, পৃষ্ঠা ০৯।
. অধ্যাপক গোলাম আযম, Islam the Only Divine & Complete Code of Life, প্রকাশঃ নভেম্বর ২০০৯, ঢাকা, পৃষ্ঠা - ১২।
. মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামের দাবী, প্রকাশঃ মে-২০১১, পৃষ্ঠা ০৯।
. অধ্যাপক গোলাম আযম, ইসলাম ও দর্শন, কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড, মূদ্রণঃ জুন ২০১২, ঢাকা, পৃষ্ঠা - ০৫।
. অধ্যাপক গোলাম আযম, পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসাবে ইসলামের সহজ পরিচয়, মুদ্রণঃ জুন ২০১২, ঢাকা, পৃষ্ঠা - ৪৮।
. ডক্টর মাহরুফ চৌধুরী, বাংলাদেশের শিক্ষা: জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=1255
. শিক্ষা-উইকিপিডিয়া, http://bn.wikipedia.org/WiKi/শিক্ষা
. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা-ইউকিপিডিয়া, http://bn.wikipedia.org/WiKi/আনুষ্ঠানিক_শিক্ষা
. প্রাগুক্ত
. উপানুষ্ঠানিকশিক্ষা-উইকিপিডিয়া, http://bn.wikipedia.org/WiKi/উপানুষ্ঠানিক_শিক্ষা
. মনসূর আহমদ, ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষানীতির ব্যর্থতা-আমাদের শিক্ষানীতি যা চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে! ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি আমাদের জন্য কি আনবে? অকটোবর ১৭, ২০০৯। সূত্রঃ http://www.sobewhovrinblog.net/blog/rajniti007blog/29027580
. মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ৫ম প্রকাশঃ মে, ২০১১, পৃষ্ঠা-৩১, ৩২ ও ৩৩
. একেএম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৪-৫
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫
. মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ৫ম প্রকাশঃ মে, ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩৩-৩৪
. অধ্যাপক গোলাম আযম, শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা, কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড, মূদ্রণঃ এপ্রিল ২০১০, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৬-১৭
২৮. অধ্যয় ০৫ঃ বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা,
সূত্রঃ www.priyoboi.com/2003/08/blog-post_6575.html
. খন্দকার আবুল খায়েব, ইসলামী জীবন দর্শন, প্রকাশঃ নভেম্বর ২০০৯, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৮-১৯।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৯।
. সালমা আক্তার মেরী, ইসলামী শিক্ষা থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে গনজাগরন, ০৭ ই জুলাই, ২০১১, সকাল ০৯:৫২, সূত্রঃ www. sonarbangladesh.com/blog/salmaaktermerry/49795
. এ.কে.এম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৭৮,৭৯ ও ৮০।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩৬।
. অধ্যাপক কে. আলী, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, মূদ্রণঃ ১৯৮৯, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৫৭৩।
. এ.কে.এম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা - ২০৫ ও ২০৬।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩৫, ১৯৪ ও ২০৫।
. English Medium Educaton, Source:
http://www.en.wikipedia.org/wiki/Engilish_medium_education
. মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ৫ম প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ৩৪ ও ৩৫।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৯।
. অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদ, পর্দার আসল রূপ, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, ৪র্থ প্রকাশঃ জুন ২০১১, পৃষ্ঠা-১৫।
. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), পর্দার বিধান, মূদ্রণঃ এপ্রিল ২০০৪, ঢাকা, পৃষ্ঠা-০৪।
. ডক্টর মুস্তাফা আস্ সিবায়ী, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, ৩য় প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০০৪, ঢাকা, পৃষ্টা-১২৭।
. শামসুন্নাহার নিজামী, পর্দা একটি বাস্তব প্রয়োজন, মূদ্রণঃ এপ্রিল ২০০৪, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৭ ও ৮।
. মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ৫ম প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩৯-৪০
. ফাহিম আহমদ, মাদ্রাসার শিক্ষা নাকি চার দেয়ালে ঘেরা বন্দি জীবন। এটা কি শুনালেন। সূত্রঃ http://www.amarbornomala.com/details3338.html
. Ammerman & Hersen. Assessment of Family Violence. 2nd ed. Page 212, John Wiley & Sons.
. অধ্যাপক খোন্দকার রোকনুজ্জামান, ইউরো-আমেরিকান সমাজের অন্ধকার দিক, সেমিনার স্মারক-গ্রন্থ (২০০৭), বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯-১০।
. অধ্যাপক গোলাম আযম, ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ, প্রকাশঃ এপ্রিল ২০০৩, ঢাকা, পৃষ্ঠা-০৬।
. মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামের দাবী, প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৮।
. ডক্টর আহমেদ ইমতিয়াজ, বাংলাদেশের শিক্ষা সংস্কার ও প্রসঙ্গিক ভাবনা, সূত্রঃ http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=1135
. মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামের দাবী, প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-২৩।
. অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, একাদশ প্রকাশঃ জুন ২০১২, ঢাকা, পৃষ্ঠা - ১০ ও ১৩।
. অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ, অনুবাদঃ অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদ, ইসলামী শিক্ষার মূলনীতি; প্রকাশঃ মার্চ ২০০৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৮-৯।
. খন্দকার আবুল খায়েব, ইসলামী জীবন দর্শন, প্রকাশঃ নভেম্বর ২০০৯, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৮।
. মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নুমানী, ইসলামী জীবন, প্রকাশঃ ২৩ শে মার্চ, ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৪।
. মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামের দাবী, প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৬৭-৬৮।
. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), তাফহীমুল কুরআন (৩য় খন্ড), ১৬শ প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৯৩।
. এ.কে.এম. আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৯২।
. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), অনুবাদঃ মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ; প্রকাশনায়ঃ আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা-৮৫।
. এ.কে.এম. আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৯২।
. ডক্টর রহমান হাবিব, ইসলাম ও জ্ঞানতত্ত্ব, প্রকাশঃ ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা - ১৩-১৪।
. ডক্টর ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী, জ্ঞানঃ ইসলামী রূপায়ন, বঙ্গানু. মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী, পৃষ্ঠা-৫৮-৬৬।
. ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আনওয়ারী, জ্ঞান ইসলামীকরণ স্বরূপ ও প্রয়োগ, প্রকাশঃ অকটোবর ২০০৯, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৪৪-৪৭।
. অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ, অনুবাদঃ অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদ, ইসলামী শিক্ষার মূলনীতি; প্রকাশঃ মার্চ ২০০৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।
. এ.কে.এম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৯৪-৯৫।
. ডক্টর আহমদ আলী, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা, প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১০, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩২।
. এ.কে.এম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৯৫।
. খুরশীদ আহ্মদ, Principles of Islamic Education, op.eit., পৃষ্ঠা-১৮-২০।
. ডক্টর এম. জাফর ইকবাল, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রেক্ষিত ইসলাম, পৃষ্ঠা-৫৩।
. অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, রাসূলুল্লাহ্র (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিআইসি, প্রকাশঃ মে ২০১১, পৃষ্ঠা - ৩৪২।
. এ.কে.এম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৯৬-৯৭।
. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), ভাষান্তরেঃ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও হাফেজ আকরাম ফারুক; শিক্ষাব্যবস্থাঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ; প্রকাশনায়ঃ ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৭-৩২।
. এ.কে.এম আজহারুল ইসলাম ও শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম, প্রকাশঃ জুন ২০০৩, দি ইসলামিক একাডেমী, কেম্ব্রীজ, যুক্তরাজ্য, পৃষ্ঠা-৯৬-৯৯।
. মাহমুদ আহমদ সুমন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলামী শিক্ষা, ১৩ই জানুয়ারী, ২০১১, সূত্রঃ www.dailybdnews.com/bangla/ index.php?moh=article&cat=ধর্মওজীবন&article=985
. মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ৫ম প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৯৬।
. হাফেজা আসমা খাতুন, আপনার শিশুকে কী শিক্ষা দিবেন, মুদ্রণঃ মার্চ ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৮।
. মুহাম্মদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামের দাবী, প্রকাশঃ মে ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৬৮।
. ডক্টর নাসের বিন আব্দুল করিম আল আকদ্, ভাষান্তরেঃ আবু সালমান মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম বিন আলী আহমদ, আহলূস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মূল আকীদার সংক্ষিপ্ত পরিচয়, রিয়াদ, সৌদী আরব, পৃষ্ঠা-১০।
. ডক্টর মরিস বুকাইলি, আল-কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান; আল-কুরআন এক মহাবিস্ময়, অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ অধ্যাপক খোন্দকার রোকনুজ্জামান, মূদ্রণঃ জানুয়ারি ২০১১, ঢাকা, পৃষ্ঠা-২১।
. গোলাম মোস্তফা, বিশ্বনবী, প্রকাশঃ অগাস্ট ১৯৯৪, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩২০।
. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহি), অনুবাদঃ মুহাম্মদ আবদুর রহীম, একমাত্র ধর্ম, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩৭।