1.1 ভূমিকাঃ

ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬) তাঁর Measure for measure নাটকের একটি অঙ্কে লিখেছেন, ‘একটি দৈত্যের শক্তি অর্জন অতি উত্তম বটে। কিন্তু দানবের মত তার প্রয়োগ সত্যিই এক বিরাট অত্যাচার’ (O, it is excellent to have a giant's strength, but it is tyrannous to use it like a giant') । ভারত দক্ষিণ এশিয়ার বড় শক্তি। জনসংখ্যা ও ভৌগলিক আয়তনে ভারত একটি বিশাল দেশ। আর এই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের মুখোশ পরিহিত সামরিক শক্তিবেত্ত এখন রীতিমত সম্ভ্রমের পাত্র। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী শক্তি। এর নাকি রয়েছে দৈত্যের মত শক্তি। ভারতের রয়েছে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী, ষষ্ঠ বৃহত্তম নৌবাহিনী ও অষ্টম বৃহত্তম বিমান বাহিনী। ভারত পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। সাধারণ এবং পারমাণবিক অস্ত্রের এমন সম্ভার হয়ত ভারতের অস্ত্রাগারে রয়েছে- যা দিয়ে ইচ্ছা করলে ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদেরকে বার কয়েক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন স্থানে নির্ধারিত টার্গেট বিদ্ধ করতে তারা সক্ষম। ধ্বংসাত্মক নানা শর এখন তাদের তূনে। কিন্তু শক্তিশালী হলেই কি সে শক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে যখন তখন? দানবের মত? জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান, আইন-কানুন লঙ্ঘন করে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকদের সীমান্তে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে? প্রাকৃতিক অনিবার্যতা ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ ভারতের অনিবার্য প্রতিবেশী। বলা যায় এটা নিয়তি নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা।
আসলে সর্বদা সৎ ও নিরীহ প্রতিবেশীকে উত্যক্ত করে এক ধরনের জান্তব আনন্দ পাওয়া ভারতের একটি নেশায় পরিণত হয়েছে। আর এই নেশার অনুমান হচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের চোখে-মুখে শুধু আধিপত্যবাদের নগ্ন পরাক্রম ছাড়া বাংলাদেশ যাত্রা লগ্ন থেকে অন্য আর কিছু দেখতে পায়নি।
পৃথিবীর মানচিত্রে ভারত নামক বৃহৎ দেশটি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ভারত বাংলাদেশের একটি বড় প্রতিবেশি দেশ। একদিকে শুধু বাংলাদেশের সাথে মায়ানমারের সীমান্ত, ধরনীর সীমারেখায় বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুত্থান হয়েছে সেও চার দশক পূর্ণ হয়েছে। তবে এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা বোনের ইজ্জত লুটিয়ে দিতে হয়েছে। সে কারণেই বিশ্বের দরবারে এ জাতি আত্মমর্যাদাশীল, দেশপ্রেমিক ও বীরের জাতি বলে গেŠরব অর্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির লগ্ন হতেই ভারতের সাথে আমাদের রয়েছে অমীমাংসিত কিছু রাষ্ট্রীয় সমস্যা। যার কল্যাণকর ও সুষ্ঠু সমাধান আজও হয়নি। এমনই একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হল সীমান্তবর্তী এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের সামরিক/বেসামরিক মানুষকে অকারণে, অকাতরে নির্যাতন করা এবং গুলি চালিয়ে হত্যা করা। মানবতা পরিপন্থী ওই ক্রিয়ার মাত্রাটি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভারতীয় সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বর্বরতা সব সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিছক তুচ্ছ ঘটনার কারণেও নিরীহ গ্রামবাসী তাদের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রক্ষা পায় না। শান্তির সীমান্ত প্রতিষ্ঠার সব প্রত্যাশা গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর বর্বরতায় দু’দেশের সীমানা হচ্ছে রক্তাক্ত। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন এক রক্তাক্ত প্রান্তর।
1.2 বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন? ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কয়েকটি দিক সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন ড. মাহবুব উল্লাহ। এগুলো হচ্ছে : ‘ভারতের বহুদিনের পরিকল্পনাটা কি? পরিকল্পনাটি হল, ভারতের ১৯৪৭ সালের পূর্ব মানচিত্রে ফিরে যাওয়া। এগুলো নেহেরু ডকট্রিন, ইন্দিরা ডকট্রিন ও গুজরাল ডকট্রিনেরই কথা। ভারত তার বহুদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ক্রমাগতভাবে কোশেশ করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় বিদ্রোহের মদদ দিচ্ছে, স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনে উৎসাহ যুগিয়েছে, ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের আয়োজন করে, ছিটমহলের জটিলতা অব্যাহত রেখে, উভয় দেশের মধ্যে সমুদ্র সীমা চিহ্নিত না করে এবং বাংলাদেশের ভেতরে পঞ্চম বাহিনী সৃষ্টি করে ভারত তার বহুদিনের পরিকল্পনা সুচারুভাবে বাস্তবায়িত করে চলছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট/করিডোর আদায় করাও ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনারই অংশ।’ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানাদিক যেমন-বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বর্তমান অগ্নিগর্ভ অবস্থা, বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে করিডোর সুবিধা লাভে ভারতের দীর্ঘ প্রয়াস, বাংলাদেশে-ভারত সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বাস্তবায়িত না হওয়া, বহু পাক্ষিকতায় ভারতের পরিকল্পিত অনাগ্রহ, প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে রেলওয়েকে কেবল নিজের স্বার্থে ব্যবহারকল্পে ভারতীয় প্রচেষ্টা, বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য অসমতা, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশকে ভারত নির্ভরকরণ প্রচেষ্টা, বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের নামে ভারত নির্ভরতা বৃদ্ধিকরণ, ভারতের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক লক্ষ্য সমূহ অর্জন প্রচেষ্টা, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, সীমান্তের বিভিন্ন অংশ অমিমাংসিত রাখা, ছিটমহল সমস্যা, তিন বিঘা করিডোর, সীমান্ত সংঘর্ষ, পুশইন, বাংলাদেশী শরণার্থী নাম দিয়ে ভারতীয়দের বাংলাদেশে পুশব্যাক, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা, বিএসএফের পাদুয়া দখল করে নেয়া, স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনে মদদদান, সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া, বাংলাদেশের
অভ্যন্তরে ভারতীয় বাহিনীর তৎপরতা, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বলকরণে ভারতীয় প্রচেষ্টা, বাংলাদেশ বিরোধী ভারতীয় প্রচারণা, চোরাচালানকে উৎসাহিত করা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিকদের আধিপত্যবাদী আচরণ ও অতিউৎসাহ, বাংলাদেশের ব্যাপক জনগণের বিশ্বাস ও আদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, বাংলাদেশের উদীয়মান শিল্প সেকটরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বহুবিধ ষড়যন্ত্র ও ডাম্পিং, ভারতের পানি আগ্রাসন তথা অভিন্ন নদীগুলির পানি বণ্টন সমস্যা- গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন-ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন-গজলডোবা বাঁধ মরণ ফাঁদ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ, সারী নদীর উৎসমুখ তথা মাইন ফ্রং নদীতে বাঁধ নির্মাণ, ফেনী নদীর পানি লুণ্ঠন, আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প, খোয়াই নদীর উৎস মুখে বাঁধ, মনু নদীর উজানে মিনি ফারাক্কা, গোমতী নদীর উজানে ভারতীয় বাঁধ, পুনর্ভবা, কোদলা, ধরলা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর উজানে বাঁধ; বাংলাদেশের যুব সমাজকে ধ্বংসে সীমান্তব্যাপী ফেনসিডিলের অসংখ্যা কারখানা স্থাপন, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা ও সমুদ্রের তলদেশের সম্পদ দখলের অপতৎপরতা, অপদখলী ভূমি হস্তান্তর না করা, অনিষ্পন্ন সীমানা নির্ধারণে সই হওয়া প্রটোকল অনুসাক্ষরে বিরোধিতা, মহুরীর চরের সমস্যা, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন, সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতন তথা পরিকল্পিত ভারতীয় সীমান্ত সন্ত্রাস ইত্যাদিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন লিখেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির জন্য ভারত নিজেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ নানা ভারতীয় আগ্রাসী অপতৎপরতার মধ্যে রয়েছে :
ক. পারিসরিক আগ্রাসন ও সীমান্ত হামলা,
খ. দেশের অস্তিত্ববিনাশী গোয়েন্দা তৎপরতা,
গ. ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন,
ঘ. ভারতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আগ্রাসন,
ঙ. শিক্ষা ব্যবস্থায় ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে আগ্রাসন,
চ. সংবাদ মাধ্যম ও তথ্য মাধ্যমে ভারতীয় আগ্রাসন,
ছ. অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতীয় প্রভাব ও আগ্রাসন এবং
জ. বাংলাদেশের পারিবেশিক পরিমন্ডলে আগ্রাসন বা পরিবেশ যুদ্ধ।
1.3 ভারতীয় সীমান্ত সন্ত্রাস
ভারতীয় পানি সন্ত্রাস, তথ্য সন্ত্রাস এবং সীমান্ত সন্ত্রাস যে একই সূত্রে গাঁথা তা বোধকরি খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে নতজানু করে ভারতীয় নীল নকশার বাস্তবায়ন করা। ভারতীয় নীল নকশার মধ্যে রয়েছে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়ন না করা, যার ফলে ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর ও গ্রহণ বিলম্বিত করার পাশাপাশি অভিন্ন নদীসমূহের মধ্য স্রোতকে, অবৈধভাবে বাঁধ, গ্রোয়েন এবং স্পার নির্মাণের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দিয়ে জেগে ওঠা চর দখলের মধ্য দিয়ে সার্বভৌম বাংলাদেশের ভূমি গ্রাস করা। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া শূন্য রেখায় নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট ভারতীয় সীমান্ত সন্ত্রাস বাংলাদেশের মতো একই ভূমি সীমার অংশীদার প্রতিবেশীর প্রতি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়। মনুসংহিতা ভারতের প্রাচীনতম এবং সর্বাপেক্ষা প্রমাণ্য ধর্মশাস্ত্র যা যুগ যুগ ধরে ভারতীয় হিন্দু সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মনুসংহিতার ১৫৮তম শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘অনন্তরমরিং বিদ্যাদরিসেবিনমেবচ। অরেরনন্তরং মিত্রমুদাসসীনং তয়োঃপরম।’ (কোন রাজার) অব্যবহিত পরবর্তী রাজাকে শত্রু এবং শত্রুর সহায়ককে শত্রু বলে জানবেন। শত্রুরাজ্যের পরবর্তী রাজাকে মিত্র এবং তাদের পরবর্তী রাজ্যের রাজাকে উদাসীন বলে জানবেন। এই শ্লোকের মূল বক্তব্য হচ্ছে, একই ভূমি সীমার অংশীদার প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের মনোভাব হবে চরম শত্রুতামূলক যা মনুসংহিতার অলঙ্ঘনীয় ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত।
মনু তার সংহিতার মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা ও নিগৃহকে ধর্মীয় রূপদান করার ফলে অত্যাচারকে ভারত একটি ধর্মীয় কর্তব্য বলে জ্ঞান করে। আবহমানকাল ধরে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের সংগে একাদিক্রমে যে নিপীড়ন চলে আসছে, তা থেকেই প্রমাণিত হয় মানবিক অধিকারকে পদদলিত করেই ‘মহান’ ভারতের নৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হাল আমলের ভারতীয় বর্গীদের উৎপাত স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর কিছুদিন পর থেকেই চলে আসছে। কখনো বেশি, কখনো কম। তবে বলা যায় বিরামহীনভাবেই বন্ধুদেশের বন্ধুদের এই অবন্ধুসুলভ আচরণ বাংলাদেশকে গ্রাস করে চলেছে।
ভারতীয় আগ্রাসনের হিংস্র থাবায় বিপন্ন মানবতা, বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। সীমান্তে পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। ফেলানীদের লাশ কাঁটা তারের বেড়ায় ঝুলে থাকে। বাংলাদেশী সীনামায় ঢুকে পশুসহ মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে বিএসএফ। ভারত আসলে অত্যাচার করে খুব আনন্দ পায়। তার মধ্যে প্রতিহিংসা ও পরশ্রীকাতরতা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি। ভারতের আচরণ অনেকটা ইসরাইলের সাথে তুলনীয়। তাদের কূটনীতি মানে চানক্যনীতি।
স্মর্তব্য, ১৯৭২ সালে মুজিব শাসন আমলে মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগের শুরু থেকেই সীমান্তে উৎপাতের কিছু নমুনা ধরা পড়ে। এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সরকার (১৯৯৬-২০০১) ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সব ধরনের সীমান্ত উৎপাত একেবারে সীমাহীন হয়ে পড়ে। দিল্লীকে তোষামোদকারী সরকারগুলোর আমলে বাংলাদেশের জন্যে সীমান্ত সমস্যা যেনো অত্যধিক বেড়ে যায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের বিএসএফ-এর অবৈধ আচরণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাধারণ সীমান্ত আইন এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের উভয়দিকে ১৫০ গজ করে যে স্থান আছে, তাকে বলা হয় ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’। সে স্থানে সীমান্তের কোনো দিকেই কোনো স্থাপনা বা পরিখা খনন করা যাবে না। কিন্তু ঐ নো ম্যান্স ল্যান্ডে ভারত কাঁটাতারের বেড়া ও সড়ক নির্মাণ, নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন, বিএসএফ ক্যাম্প স্থাপন ইত্যাদি করেই চলেছে। এসব অবৈধ কাজে বিএসএফকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কখনো কখনো বিএসএফের আবরণে সাহায্য দিয়ে আসছে। তখন ছোটখাট সীমান্তযুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষ বছর ২০০১ সালে ভারতীয় বাহিনী সিলেট সীমান্তে পাদুয়া দখল করে নেয়। কিন্তু বিডিআর-এর বীর জওয়ানরা পাদুয়াকে দলখমুক্ত করে সে বছরের ১৫ এপ্রিল। এরপর ঐ মাসেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত লংঘন করে কুড়িগ্রাম জেলার বড়াইবাড়ি গ্রামে ঢুকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিএসএফ-এর একটি কোম্পানী গ্রামটি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু দখলকারীরা যখন দেখে যে, সীমান্তে বিডিআর ক্যাম্প থেকে কোনো সাড়া বা প্রত্যুত্তর নেই, তখন তারা ভাবে বিডিআরের লোকজন ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এই ভেবে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের আরো ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। বিডিআর ক্যাম্প থেকে মেশিনগানের রেঞ্জের ভেতরে আসার পরপরই তাদের ওপর বিডিআর ক্যাম্পে অবস্থিত প্লাটুনটি গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলে নিহত হয় ১৭ জন ভারতীয় সেনা এবং আহত হয় অনেকে। নিহতদের লাশ ফেলে, আহতদের নিয়ে আক্রমণকারীরা কোনোক্রমে পালিয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটে ঐ বছরের ১৮ এপ্রিল। এ দু’টি ঘটনা নিয়ে ভারতীয় লোকসভায় অর্থাৎ পার্লামেন্টে তুমুল হৈ চৈ হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপি’র এক উন্মত্তপ্রায় সদস্য পার্লামেন্ট ভবনে চিৎকার করে ঢাকায় অবস্থিত বিডিআর হেড কোয়ার্টার্স বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার দাবি জানায়। অপরদিকে, দিল্লি বিডিআরের বিজয়ী বীরদের এবং তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল আ.ল.ম. ফজলুর রহমানকে কঠোর শাস্তি দেয়ার জন্য ঢাকার ওপর জোর চাপ দিতে থাকে। দেশের জনমত এবং পত্র-পত্রিকার মতামত উপেক্ষা করে ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তারা সিলেটের পাদুয়াকে আবারো ভারতের দখলে দিয়ে দেয় এবং বিডিআর প্রধানকে তার পদ থেকে অপসারণ করে। বিডিআরের দেশপ্রেম, সাহস ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা সরকারের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অপরাধ?
‘ভারত তার সীমান্তে বিদ্যুৎ-সঞ্চালিত দুই পরত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে যাতে কোনো বাংলাদেশী তার দেশে ঢুকতে না পারে। ভুল করেও কোনো বাংলাদেশী সে বেড়ার ধারে-কাছে গেলে তাকে চড়ুই পাখির মতো গুলি করে মারা হচ্ছে। সীমান্তে হাজার হাজার বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এসব হত্যা বন্ধ করতে পারছেন না, উল্টো তিনি বাংলাদেশের নদী, বাংলাদেশের বন্দর, বাংলাদেশের সড়ক আর বাংলাদেশের রেলপথ খুলে দিয়েছেন ভারতের জন্য। রাষ্ট্রের শত্রু, বিদেশী নাগরিক আর ভারতের দালালদের তিনি উপদেষ্টা নিযুক্ত করেছেন, তারা বলে যে বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কোনো রকম ফি কিংবা মাশুল চাওয়া অসভ্যতা হবে।’
এডভোকেট বাবুল দে লিখেছেন, ‘সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার বিষয়টি অমানবিক নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পড়ে। সীমানা লংঘনকারীকে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। তাই বলে হত্যা চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন।’
সিলেটের সাংবাদিক মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন লিখেছেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তবর্তী এলাকার কোথাও না কোথাও সংঘটিত হয় গুলির ঘটনা। আর এসব গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশের নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র ব্যক্তিরা। যাদের পরিচয় সাধারণ কৃষক, দিনমজুর কিংবা ব্যবসায়ী। এসব হত্যাকান্ডের পরপরই দু’দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দায়সারা কোনো রকম একটি বিবৃতি দিয়েই ঘটনাকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। সরকার ভারতের এমন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। যার ফলে ভারত অন্যান্য সীমান্তে নির্বিচারে গুলি চালাতে না পারলেও ঠিকই বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর গুলি চালায়।’
বিএসএফ-এর নির্যাতন বর্তমানে চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। মোহাম্মদ আবদুল সেলিম লিখেছেন, ‘একটি বিষয় বা ইস্যু ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তা হলো, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে বিএসএফ বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স কর্তৃক ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশী সাধারণ বা নিরীহ মানুষ হত্যার বিষয়। এ নিয়ে উভয় দেশের সীমান্তে প্রায়ই ঘটছে আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়। দেখা যাচ্ছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। তবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে উভয় দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর বেপরোয়া কর্মকান্ডের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের দ্বারা বাংলাদেশী অপহরণ, গুম, হত্যা ইত্যাদি যেন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের তান্ডবে নিরীহ গ্রামবাসী উপায়ন্তর না পেয়ে নিজ বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে নিরাপদ স্থানে। পালানো বা আত্মরক্ষার সময়েও অনেকে তাদের ছোড়া গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কেউবা আহত অবস্থায় কোনোরকমে সেখান থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়। ভারতের একতরফা আক্রমণে সীমান্তজুড়ে বাংলাদেশীরা দিন কাটাচ্ছে আতংকের মধ্য দিয়ে। এ আতংক কবে নাগাদ কাটবে তা জানে না ভুক্তভোগী বাংলাদেশীরা। গণমাধ্যমে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক আক্রমণ, হত্যা, অবৈধ প্রবেশ ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সরকার যেন এ ব্যাপারে একেবারেই চুপচাপ।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম লিখছেন, ‘মহান ভারত মানবের দেশ, দানবের নয়। পৌরাণিক যুগে শূর-অসুরের, দেব-দানবের লড়াইয়ের অনেক উপাখ্যানে এমন চরম নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে সদা সর্বদা অসুরের নয়, শূরের জয়জয়কার দেখা যায়। সে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রেই হোক, আর সীতা হরণে লঙ্কাপতি রাবনই হোক। কোথাও কোনো দানবের জয় হয়নি। সর্বত্রই মানবের আর মানবতার জয়জয়কার। কিন্তু হায়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ইদানীং একি দেখি! ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দিনের পর দিন নিষিদ্ধ পাখি শিকারের মতো সীমান্তে নিরীহ মানুষকে গুলি করে মারছে। কোনো প্রতিকার নেই। কেন এই নিষ্ঠুরতা? এ দিয়ে তারা কি অর্জন বা বুঝাতে চায়? এটা কি ভারতের জাতীয় অনুভূতি? নাকি সীমান্তরক্ষী বিএসএফ’র উচ্ছৃঙ্খলতা? এসব জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার সময় মনে হয় এখন এসে গেছে।’
বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের আগ্রাসী বেপরোয়া সীমান্ত হত্যাকে বিশেষজ্ঞরা ভারতের দানবীয় মূর্তি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের আরেক রূপ। যখন রাষ্ট্রশক্তি
আন্তর্জাতিক আইন-কানুন ও রীতিনীতি লংঘন করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তখন তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণেই ভারত বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী ধিকৃত।
বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম. ফজলুর রহমানের মতে, ‘সীমান্ত অতিক্রম করছে বলে কাউকে মেরে ফেলার বিধান পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সীমান্ত অতিক্রমের অপরাধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ নিজ দেশের আইনের হাতে ন্যস্ত করাই হচ্ছে বিধান। আইন অনুযায়ী আদালত অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে দন্ড দেবেন। দেখামাত্রই গুলি করে মেরে ফেলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।’
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদের ভাষায়, ‘‘সীমান্তে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের দেশের সকল মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত আমাদের প্রতি অবিচার, অনাচার ও নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতের শাসকরা আমাদের অতীতে যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছে তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উল্টো আমাদের সীমানাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দুই দেশের মধ্যে প্রতিবেশী হিসেবে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিলো তা ততটা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। এর জন্য দায়ী সরকার ও তার তোষণনীতি।’
১.৪ বাংলাদেশের সীমানাজুড়ে হত্যাকান্ড : কিছু পরিসংখ্যান
শুধু বাংলাদেশের ভূমি দখল করেই নয়- হিংস্র দানব প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার অক্টোপাস ভারত ১৯৭১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৯৩০০ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশী অপহৃত হয়েছে। ৮২৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে। কেবলমাত্র ২০০১ সালের ১০ অকটোবর থেকে ২০০৬ সালের ১৮ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে ভারতীয় বর্বর সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-র হাতে ৩৭৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। ৪৩৮ জন গ্রেফতার এবং ৪২০ জন অপহৃত হয়েছে। ৮ শিশুসহ ৫৩ জন নিখোঁজ হয়েছে এবং ১৬ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে।
সীমান্ত সন্ত্রাসে ভারতের আগ্রাসনে বহু বেসামরিক বাংলাদেশী নাগরিক প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে। এমন নীরব ও নির্বিচার হত্যাকান্ডের নজির পৃথিবীতে বিরল।
বিডিআরসহ ঐ হতভাগা বাংলাদেশী নাগরিকদের বেশিরভাগই বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারায়। শুধু ২০০০ সালে বিএসএফ’র হাতে মোট ৩৫ জন বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছেন। ঢাকার ইংরেজী দৈনিক The Independent গত ১২ ডিসেম্বর ২০০০ সংখ্যায় এক সরকারী সূত্রের উল্লেখ করে ‘35 BDR men killed in border skirmishes this year’ শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাসমূহ ভারতীয় সীমানা রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর নিরীহ বাংলাদেশীদের উপর হিংসাত্মক হত্যাকান্ড ও আক্রমণের খবর প্রায়শই প্রকাশ করে থাকে। ৩০ মার্চ ২০০১ তারিখের দৈনিক যুগান্তর ইউএনবি’র বরাতে এক খবর দিয়ে লিখে যে, বিএসএফ চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার চাঁদপুর গ্রাম থেকে এক বাংলাদেশী তরুণ জুলুকে (২৭) অপহরণ করে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। ১৩ মার্চ ২০০১ তারিখের দৈনিক মানব জমিনের সিলেট অফিসের এক প্রতিবেদনে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত জকিগঞ্জের সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা নদীতে খলিলুর রহমানের লাশ পাওয়ার খবর জানা যায়। ১৫ জানুয়ারী ২০০১ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘সাতক্ষীরা সীমান্তে বিএসএফ’র উস্কানিমূলক তৎপরতা : এক মাসে ১৫ জনের মৃত্যু। ইত্তেফাকের সাতক্ষীরা সংবাদদাতার ঐ খবরে প্রকাশ গত ১১ জানুয়ারী ২০০১ সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার খাঞ্জিরা সীমান্তের ইছামতি নদীর ঘারকাঘাটে ভারতীয় হানাদার বিএসএফ’র একটি টহলদার গানবোট বাংলাদেশের পানিসীমায় প্রবেশ করে বাংলাদেশের একটি যাত্রীবাহী নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে দুদলি গ্রামের জিন্নাহ নামের ৩২ বছরের এক যুবককে হত্যা করে। একইভাবে ঐ জানুয়ারী মাসের ৬ তারিখে বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের কালিন্দী নদীতে আর একটি যাত্রীবাহী নৌকায় বিএসএফ গুলি চালিয়ে ২ জনকে এবং ইছামতী নদীতে বাংলাদেশী আরো ৪ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে বলে ইত্তেফাকের (১৫-০১-২০০১) ঐ রিপোর্টে প্রকাশ।
গত ২০ ডিসেম্বর, ২০০০-এর দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত অপর এক খবরে দেখা যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-র গুলিবর্ষণে বাংলাদশের রাজশাহী জিলার চরখিদিরপুর সীমান্তে খুশবু নামের একজন বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ী আহত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন হয়। ঐ ঘটনায় বিএসএফ বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৪৭টি বৈধভাবে আমদানিকৃত গরু জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়।
১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে ২০০০ পর্যন্ত মোট ১১ বছরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশের মোট ২২৮ জন নাগরিক নিহত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের বিডিআর-এর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী, হিন্দু উগ্রবাদী এবং ভারতীয় নাগরিকদের নগ্ন হামলা, ভূমিদখল, লুটতরাজ, নারী-ধর্ষণ, অপহরণ ও চোরাচালানসহ অন্যান্য আগ্রাসন বাংলাদেশে বর্তমানের আওয়ামী শাসনামলে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিচের ছকে বিগত এক যুগে তথা ১২ বছরে ভারতীয়দের হাতে নিহত ও আহত বাংলাদেশী নাগরিকদের হিসাব তুলে ধরা হলোঃ

সারণী-১
ভারতীয় বিএসএফ-এর হাতে নিহত এবং আহত বাংলাদেশী নাগরিকদের বছরওয়ারী হিসাব (১৯৯০-২০০১ সময়কাল)।

সন নিহত আহত আক্রমণ ও গোলাগুলির ঘটনা
১৯৯০ ২৯ ১৯ -
১৯৯১ ২৭ ১৭ -
১৯৯২ ১৬ ১৩ -
১৯৯৩ ২১ - -
১৯৯৪ ২১ ১৪ ১৭০
১৯৯৫ ১২ ৯ ৭৫
১৯৯৬ ১৩ ১৮ ১৩০
১৯৯৭ ১১ ১১ ৩৯
১৯৯৮ ২৩ ১৯ ৫৬
১৯৯৯ ৩৩ ৩৮ ৪৩
২০০০ ৩৯ ২৬ ৪২
২০০১ ৯৪ ১০২ ৫৮
তথ্য: ২২-২৫ অকটোবর, ২০০০ তারিখ ঢাকার পীলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে বিডিআর-বিএসএফ শীর্ষ পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্যানুসারে উপস্থাপিত রিপোর্ট, দৈনিক সংগ্রাম, ২৯-১০-২০০১। ২০০০-২০০১ সালের হতাহতের হিসাব মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকারের’ রিপোর্ট থেকে নেয়া হয়েছে। দেখুন, দৈনিক ইনকিলাব, ২৭ জুলাই, ২০১২, পৃ-১২।

উপরোল্লিখিত ছক থেকে দেখা যায় যে ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের অকটোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে মোট ২১৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছে ভারতীয় বিএসএফ-র গুলিতে; আহত হয়েছে মোট ২১৪ জন বাংলাদেশী। ঐ সময়ে সীমান্তে সর্বমোট ৩৬৮টি ভারতীয় হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা সংঘটিত হয়।
উপরোক্ত সময়কালে শুধু কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী সীমান্তে বিএসএফ ৩১জন নিরপরাধ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে ২৮ জন সাধারণ মানুষ এবং ৩ জন বিডিআর জওয়ান। একযুগে রৌমারী সীমান্তে বিএসএফ-র গুলিতে নিহত সাধারণ বাংলাদেশীদের অনেকের লাশও তাদের পরিবার ফেরত পায়নি। এদের সবাইকে বাংলাদেশ ভূখন্ডের ভেতরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করার পর বিএসএফ সদস্যরা ঐসব লাশ পশুর মৃত দেহের মত টেনে হিচড়ে নিয়ে চলে যায়। ২০০১ সালের ১৭ জুন বিএসএফ লালমনিরহাট জেলার কুচলিবাড়ী সীমান্তে বাংলাদেশে প্রবেশ করে একজন কৃষককে হত্যা করে। এর আগে ১৪ জুন ২০০১ চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সীমান্তে হত্যা করা হয় ৩ জন বাংলাদেশী কৃষককে। এ সময় ৬ জন বাংলাদেশীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯ জুন ২০০১ হালুয়াঘাট সীমান্তে গুলি চালিয়ে বিএসএফ হত্যা করে আরো একজন কৃষককে। ২০০১ সালের ৫ জুলাই বিনা উস্কানিতে সীমান্ত আইন লংঘন করে বিএসএফ কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি সীমান্তে বাংলাদেশ সীমান্তের ২০০ গজ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মফিজুর রহমান (৩৫) কে অপহরণ এবং রৌমারী সীমান্তে ফুল মিয়াকে (৩২) গুলি করে গুরুতর আহত করে।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০০২ দৈনিক ইত্তেফাকের এক রিপোর্টে ২০০২ সালের জানুয়ারী-অগাস্ট এই ৮ মাসে বিএসএফ’র গুলিতে ৮৫ জন বাংলাদেশী নির্মমভাবে নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। রিপোর্টে বলা হয়, বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত এলাকায় বিনা উস্কানিতে বাংলাদেশী নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করে হত্যার বিষয়টি আশংকাজনক হারে বাড়ছে।
দৈনিক ইনকিলাবের ৪ অগাস্ট ২০০৪ এর এক রিপোর্টে বলা হয় যশোর সীমান্তে এক পক্ষ কালের ব্যবধানে বিএসএফ ৪ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে লাশ টেনে হেঁচড়ে ওপারে নিয়ে যায়। যশোরের শিকারপুর সীমান্তে জমিতে সেচ দেয়ার সময় ১৫ই জুলাই ২০০৪ বিএসএফ গুলি করে শিকারপুর গ্রামের কৃষক করিম বক্সকে হত্যা করে লাশ নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ফ্লাগ মিটিং-এর মাধ্যমে ঘটনার তিনদিন পর লাশ ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ২০০৪ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে সাতক্ষীরার কলারোয়ার চান্দা সীমান্তে আশ শিকড়ী ক্যাম্পের বিএসএফ রামভদ্রপুর গ্রামের মনিরুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে। একই সময়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে পদ্মায় মাছ ধরার সময় দোমাকুল ক্যাম্পের বিএসএফ উদয়নগর গ্রামের রফিক উদ্দিন ও মন্টু ব্যাপারীকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া ঘিবা, পলিয়ানপুর, শিকারপুর, শালকোনা, সামান্তা ও যাদবপুরসহ বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ সীমান্ত ঘেঁষা জমিতে ও বিভিন্ন নদ-নদীতে কাজ করতে যাওয়া সীমান্তবাসীদের বিনা কারণে রাইফেল উঁচিয়ে তেড়ে আসে এবং মারপিট করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
দৈনিক ইনকিলাবের দিনাজপুর রিপোর্টার মাহফুজুল হক আনার এর রিপোর্টে ৫ অগাস্ট ২০০৪ উল্লেখ করা হয় যে, দিনাজপুর সীমান্তে বিএসএফ প্যারাসুট বোমা নিক্ষেপ করায় বিচ্ছুরিত অগ্নিকান্ডে ২ জন বাংলাদেশী আহত এবং একটি বসত ঘরে আগুন লেগে যায়। এর আগে আরো কয়েকবার তারা একই সীমান্তে বাংলাদেশী অংশে বাঁধ নির্মাণে বাধা প্রদানের পর প্যারাসুট নিক্ষেপ করে আতংক সৃষ্টি করেছিল।
দৈনিক নয়াদিগন্তের ১৪ মার্চ ২০০৫ এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে বিএসএফ ও ভারতীয় দুর্বৃত্তদের হাতে প্রতি পাঁচদিনে একজন বাংলাদেশী নিহত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই তাদের হাতে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অধিকার জানায়, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও এর ফলে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাদেশী নাগরিকরা আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছে। অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, গত ৫ বছর ২ মাস ১২ দিনে বিএসএফ এবং ভারতীয় দুর্বৃত্তদের হাতে ৩৭৭ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৪৬৬ জন, গ্রেফতার হয়েছে ৪৬৭ জন, অপহৃত হয়েছে ৪৯১ জন, ৮ শিশুসহ ৩৯ জন নিখোঁজ এবং ৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া একই সময় ৪৮টি ছিনতাই এবং লুটের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বিএসএফ’র হাতে বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৮৩৮ জন বাংলাদেশী নাগরিক। বিএসএফ’র হাতে হত্যাকান্ডের শিকার সিংহভাগই হচ্ছে নিরীহ কৃষক। মাঠে কাজ করার সময় বিনা কারণে বিএসএফ তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে এবং অপহরণ করে নিয়ে যায়। দৈনিক সংগ্রামের চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সংবাদদাতা ২৯ মার্চ ২০০৫ জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ও ঘোষ বাহিনীর সশস্ত্র হামলা বেড়েই চলেছে। বিএসএফ ও ঘোষ বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে মানুষ হত্যা, অপহরণ এবং ফসল ও গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। কিন্তু কোন প্রতিকার হচ্ছে না। গত ৫ বছরে বিএসএফ ও ঘোষ বাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সীমান্তে ৫১ বার সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা, ১৩ জনকে অপহরণ, ৩০ জনকে আহত করে। এ ছাড়া প্রায় ১৭শ গবাদি পশু ও কয়েকশ বিঘা জমির ফসল লুট করে নিয়ে যায়। গত ৯ মার্চ ২০০৫ সন্ধ্যায় গোমস্তাপুর উপজেলার রোকনপুর সীমান্ত দিয়ে একদল সশস্ত্র ভারতীয় দুর্বৃত্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে মো. আলম (২২) নামের এক যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ সীমান্তের ওপারে নিয়ে যায়।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-র হাতে ১২ জন বাংলাদেশী নিহত, ৪ জন বাংলাদেশী আহত এবং ৩ জন অপহৃত হয়েছেন। অধিকারের এক রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারী থেকে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ১৪ মাসে ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়েছে ১৩ জন হতভাগ্য বাংলাদেশী নাগরিক। ২০০৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী হরিপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে আনোয়ারুল হক নামে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়।
২০০৮ সালের ১৭ জুলাই থেকে ২০ জুলাই ৪ দিনে বিএসএফ চাঁপাইনবাবগঞ্জের রঘুনাথপুর সীমান্তে ২ বিডিআর ও ৩ বাংলাদেশীসহ মোট ৫ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। বিএসএফ এ হত্যাকান্ড চালিয়েছে এমন এক সময় যখন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে দিল্লীতে সচিব পর্যায়ে বৈঠক চলছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০০-২০০৭ পর্যন্ত ৭০৭ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
২২ এপ্রিল ২০০৯ রাতে সাতক্ষীরা সীমান্তে স্বামীকে গাছে বেঁধে রেখে বাংলাদেশী এক মহিলাকে বিএসএফ ধর্ষণ করে। প্রতিবাদ করায় স্বামীকে হত্যা করেছে পাষন্ড বিএসএফ সদস্যরা। সাতক্ষীরার লক্ষ্মীদাড়ি সীমান্তের বিপরীতে ভারতের ঘোজডাঙ্গায় এ ঘটনা ঘটে। ৯ জুন ২০০৯ সকালে লাল মনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইসলামপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে সেলিম মিয়া নিহত হয়। তার বাড়ি ওই সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকাতেই। সীমান্তের ৮৪২ নং মেইন পিলারের নিকটেই সকালে হাটাহাটি করার সময় বিএসএফ’র টহল দল তাকে গুলি করে। ১০ জুন ২০০৯ বুড়িমারী সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক সাজুকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। ২০০৯ সালের মে মাসেই বিএসএফ হত্যা করেছে ১০ বাংলাদেশীকে। জখম করেছে ৭ জনকে, অপহরণ করেছে ৩ জনকে আর ১১ জনকে পুশইন করেছে। আর সীমান্ত থেকে নিখোঁজ হয়েছে ৮জন। জানুয়ারী-জুন ২০০৯ এ ৬ মাসে বিএসএফ’র গুলিতে কমপক্ষে ৫০ জন বাংলাদেশী খুন হয়েছে। লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফ’র সহায়তায় ভারতীয় দুষ্কৃতিকারীরা সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশী গরু-ছাগল, এমনকি ক্ষেতের ধানও কেটে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ নিজেদের সম্পদ রক্ষার সুযোগ পায় না। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, ২০০৮ সালের জানুয়ারী থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত বিএসএফ’র হাতে ১২১ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। আর ২০০৯ সালের জানুয়ারী থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়েছে ৫৯ জন বাংলাদেশী। গত ১০ বছরে বিএসএফ ৮৪৮ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছে ৬৪৬ জন। বিএসএফ’র হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩ জন বাংলাদেশী নারী। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর হদিস পাওয়া যায়নি এমন সংখ্যা ৭৪। ভারতের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকান্ডের শিকারদের চোরাচালানি বলা হলেও তাদের অধিকাংশ নিহত হয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে। তাদের অনেকে নিহত হয়েছেন ধান ক্ষেতে কাজ করার সময়। নিছক বাংলাদেশীদের লক্ষ্য করে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে শিশু-কিশোররাও রয়েছে।
২০০৯ সালে বিএসএফ’র ঘটানো প্রধান কয়েকটি হত্যাকান্ড হচ্ছে : ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সাতক্ষীরা সীমান্তে ২ জন, সিলেট সীমান্তে ফুরকান ও নান্নু মিয়া নামক ২ জন, একই তারিখে বিয়ানী বাজার সীমান্তে ২ জন; ২৪ ফেব্রুয়ারী বিরামপুরে মমতাজ (২১); ২৭ ফেব্রুয়ারী দিনাজপুর সীমান্তে ২ জন; ৬ মার্চ তেতুলিয়ায় সামছুদ্দিন (৩০); ১৩ মার্চ নওগাঁ ও মহেশপুরে বারিক ও ওয়াকার নামক দুই কিশোর; ২১ মার্চ সাতক্ষীরা সীমান্তে বকুল হোসেন (১৮) ও সুলতান হোসেন; ৬ এপ্রিল কুড়িগ্রামে ইব্রাহীম (২৫); ৯ এপ্রিল দিনাজপুরে কাছিম উদ্দিন; ২১ এপ্রিল ঝিনাইদহে আবদুল খালেক (২৮); ৩ মে চাঁপাই সীমান্তে আমিরুল ইসলাম (৩০); ৫ মে বেনাপোল সীমান্তে মধুমিয়া (২৫); ২৪ এপ্রিল ঝিনাইদহে হারুন অর রশীদ (২২); ২৯ এপ্রিল নওগাঁয় ২ জন; ১২ জুন রুদ্রপুরে সাইদুর রহমান (২৮); ১৩ জুন বিরামপুরে মজিবুর রহমান (৩০); ১৮ জুন বুড়িমারিতে সেলিম মিয়া (৩৫); ২৮ জুন ছাগলনাইয়ায় বাহার (৩৫); ৬ জুলাই সাতক্ষীরায় মফিজুল (২৪); ৯ জুলাই শার্শায় সবুজ (২২), আহমদ (২০), আরিফুল ইসলাম (২৫) ও আবদুস সালাম (২২); ১১ জুলাই চাঁপাই-এ জমিরুল ইসলাম (২৪); ১২ জুলাই বিরামপুরে ২ জন; ৭ জুলাই পাঁচ বিবিতে হামিদ মন্ডল (৩২); ৩০ জুলাই চুয়াডাঙ্গায় মিজান (২২); ৪ অগাস্ট চাঁপাই-এ মতিউর রহমান (২৫), সুবেদ আলী (২৭); ৭ জুলাই বুড়িমারিতে ১ জন; ৯ অগাস্ট যশোরের গ্রভুলট সীমান্তে সবুজ (২২), আহমদ (২২), আরিফুল (২৫), আবদুল মান্নান (২২); ২৬ অগাস্ট বেনাপোলে এরশাদ আলী (৩২); ৯ সেপ্টেম্বর চাঁপাইয়ে মনির হোসেন (২৪), ১৪ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর সীমান্তে ২ জন ও ১৭ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর সীমান্তে ৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৬ নবেম্বর কুড়িগ্রামে ছাগল খুঁজতে গিয়ে এক কিশোরী বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়। ৬ অকটোবর সাতক্ষীরা বকচরা নদীতে মাছ ধরার সময় বিএসএফের স্পিড বোটের ধাক্কায় আনোয়ার নামের এক বাংলাদেশী নিহত হয়। ইচ্ছে করেই বিএসএফের স্পিড বোড এ ধাক্কা দেয়। দৈনিক কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায় ২০০৯ সালে বিএসএফ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে ৮৯ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সবচেয়ে বেশি সাতক্ষীরা সীমান্তে ২২ জন, যশোর সীমান্তে ১৬ জন, ঝিনাইদহ সীমান্তে ৭ জন এবং চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে ২০০৯ সালে বিএসএফ ৯৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে, বিএসএফ’র হাতে আহত হয়েছে ৭৯ জন। এছাড়া ২৫ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। ৯২ জন নিখোঁজ রয়েছে।
২০১০ সালের জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে বিএসএফ’র গুলিতে মারা যায় ১৫ জন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১০ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজহাট ইউনিয়নের ডিবির হাওর এলাকা থেকে বিডিআর নায়েক মুজিবুর রহমানকে গুলি করে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। ১৭ ফেব্রুয়ারী তামাবিল সীমান্তে বিএসএফ ও বিডিআর’র মধ্যকার পতাকা বৈঠকের পর বিএসএফ সদস্যরা নায়েক মুজিবরকে ফেরত দেয়। এছাড়া গত ২৬ ও ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১০ বিএসএফ সদস্যরা একই সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করে বাংলাদেশী নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
জুন ২০১০ সীমান্তে অন্তত ৬টি স্থানে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বিএসএফ। জানুয়ারী-জুন ২০১০ এ ৬ মাসে ৩৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনকে পিটিয়ে ও ২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া বিএসএফ একই সময়ে ৪১ জনকে আহত করেছে। ৫ জুলাই ২০১০ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর সীমান্তে বিএসএফ’র ছত্রছায়ায় ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে ৫ বাংলাদেশী কৃষক আহত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইউরোনিয়ামসহ দুর্লভ ও মূল্যবান বেশ কিছু খনিজ সম্পদ আবিস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় বিএসএফ সিলেটের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্নভাবে আগ্রাসন চালাচ্ছে। ২০১০ সালের প্রথম ৬ মাসে সিলেট সীমান্তে সবচেয়ে অধিক সংখ্যক গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
২১ অকটোবর ২০১০ কুষ্টিয়া সীমান্ত থেকে ৫ জন বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ। ১৬ অকটোবর ২০১০ বিএসএফ’র হত্যাকান্ডের শিকার হয় ৩ জন। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সন্ন্যাসী পাড়া গ্রামের জসিম উদ্দিন নামে এক বাংলাদেশী কৃষক বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হন। ফসলের জমি দেখতে গেলে বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শিংনগর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে খুন হন বাংলাদেশী নাগরিক আবদুল লতিফ এবং পঞ্চগড় সীমান্তে ভারতীয় হায়েনাদের হাতে নিহত হন এক বাংলাদেশী নাগরিক। এর আগে ৫ অকটোবর ২০১০ শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তে সাধন ঘোষ নামে অপর এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় পুলিশ। ঘটনার তিন দিন পর তার লাশ হস্তান্তর করা হয়। ১২ অকটোবর লালমনিরহাট সদর উপজেলার দুর্গাপুর সীমান্তে এক বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার করা হয়। বিএসএফ তাকে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে লাশ ফেলে যায়। ১৮ অকটোবর ২০১০ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ সীমান্ত থেকে ফারুক মিয়া, আশিক, ফারুক, সুমন আলী ও সুমন নামে ৫ নাগরিককে ধরে গেছে বিএসএফ। তাদের বাড়ি রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মুন্সীগঞ্জ ভাঙ্গাপাড়া গ্রামে। গরুর জন্য খাবারের ঘাস কাটতে গেলে ভারতের নদিয়া জেলার হোলবাড়িয়া থানার কৃষাণ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা তাদেরকে আটক করে নিজ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর ২০১০ বিএসএফ সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের ইসমাইলের পুত্র কবিরুল ইসলাম (৩৪) কে কলারোয়া সীমান্তে গুলি করে হত্যা করে। ২৪ ডিসেম্বর ২০১০ রাজশাহীর খানপুর সীমান্তে বিএসএফ’র নির্যাতনে এক গরু ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত তিন বছরে বিএসএফ’র হাতে ২৫৬ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। একই সময়ে আহত হয়েছেন ১৬৮ জন এবং ১৬৭ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১১ ভোররাতে বেনাপোলের পুটখালি সীমান্তে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ইসরাফিলকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিএসএফ। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বিএসএফ’র গুলিতে ও শারীরিক নির্যাতনে মরা গেছে ৬৩ জন বাংলাদেশী। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সীমান্তে ২৬ জন, যশোর সীমান্তে ২৫ জন, ঝিনাইদহে ৮ জন ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ৪ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৯ জনকে গুলি করে এবং ৩৪ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও বিদ্যুতের শক দিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে গুলি ও নির্যাতন চালিয়ে আহত করা হয়েছে।
১.৫ সীমান্তের কাঁটাতারে নিষ্পাপ কিশোরী ফেলানীর উপুড় হয়ে থাকা ঝুলন্ত লাশ
এ যেন ভারতের কাঁটাতারের বেড়ায় নিরীহ ফেলানীর লাশ নয়, ঝুলছে বাংলাদেশ। বাবা-মায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর ১৫ বছর আগে জন্ম নেয়া এই শিশুটি যাতে বেঁচে থাকে, সে আশা নিয়েই তার নাম রাখা হয়েছিল ফেলানী। বধূ বেশে স্বামীর ঘরে যাওয়ার মতো করে মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন মা জাহানারা বেগম। চারচালা টিনের ভাঙা বেড়ার ঘরে বসে সেই স্মৃতিই রোমন্থন করছিলেন মা জাহানারা বেগম। বলছিলেন, সঞ্চয় যা ছিল সব দিয়ে সোনা রূপার গয়নাও পরিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু তার মেয়ে লাশ হয়ে ফিরেছে নিজের ঘরে। গত ৭ জানুয়ারী ২০১১ প্রত্যুষে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তের দক্ষিণ অনন্তপুর হাজিটারী গ্রামের ৯৪৭/৩ এস আন্তর্জাতিক পিলারের কাছে ভারতীয় অভ্যন্তরের খেতাবেরকুটি এলাকায় নির্মমভাবে ঠান্ডামাথায় গুলি করে ফেলানীকে হত্যা করে বিএসএফ। ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা থানার চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফরা এই হত্যায় জড়িত ছিল।
ফেলানীর লাশ যেভাবে উদ্ধার করা হয় : নাগেশ্বরীর কাশিপুর বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার আবদুল জববার মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের অনুসন্ধান দলকে জানান, গত ৭ জানুয়ারী আনুমানিক ৬টা ১৫ মিনিটে সংঘটিত ফায়ারের পরপরই অনন্তপুর বিওপির বিজিবি টহলদল ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে বিজিবি সদস্যরা তৎক্ষণাৎ ফেলানীর লাশ দেখতে পায়নি। পরে সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে বিজিবি টহল দল কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে বেশ উপরে নিহত ফেলানীর লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। ওইদিন সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া থেকে নিহত ফেলানীর লাশ নামিয়ে পশুর মত বাঁশে ঝুলিয়ে সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের জন্য ভারতের কুচবিহারে নিয়ে যায়। আনুমানিক সকাল ১১টায় কোম্পানী কমান্ডার নায়েব সুবেদার মো. আবদুল জববার নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ ফেরত চেয়ে বিএসএফ’র কাছে চিঠি পাঠান এবং তাদের পতাকা বৈঠকের বসার অনুরোধ জানান। কিন্তু বিএসএফ’র পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ৮ জানুয়ারী সকাল ১১টায় বিজিবি-বিএসএফ’র মধ্যে পতাকা বৈঠক শুরু হয় এবং সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে পতাকা বৈঠক শেষে বিএসএফ প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর নিহত ফেলানীর লাশ
হস্তান্তর করে।
ফেলানী পৈশাচিকতার শিকার : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাঁধন অধিকারীর লেখা ‘‘কাঁটাতারে ঝুলন্ত মানবাত্মা’’ ঘুমন্ত বিবেক বোধকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয়ার মতো। (১৭ জানুয়ারী দৈনিক আমার দেশ পাঠকমেলা) ফেসবুকে বাঁধনের বন্ধুরা বলছেন, ‘কাঁটাতারে ঝুলছে বাংলাদেশ।’ বাঁধন তার থেকে একটু সরে বলছেন, ‘বাংলাদেশ না, কাঁটাতারে ঝুলছে মানবাত্মা। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি মিডিয়া-মার্কেট-মিলিটারী যুগের বৈশিষ্ট্যকে বুকে ধারণ করে ভারত নামের রাষ্ট্রটির সঙ্গে সে স্বার্থগত বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, ঋণচুক্তি-ট্রানজিট-টিপাইমুখ-পানি নিয়ে ভারতীয় সাম্রাজ্যের যে আগ্রাসন, সবকিছুকে ছাপিয়ে ওই মানবাত্মার কান্নার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি আমি। ওই মানবাত্মা আমার; সে ভারত বোঝে না, সে বিএসএফ বোঝে না, পরিবর্তিত নামে আবির্ভূত হওয়া বর্ডার গার্ড বোঝে না।’
বাঁধন আরও লিখেছেন, ‘কেন পানি পানি বলে চিৎকার করেছিল ফেলানি? পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি, পারিনি আমরা দুর্বল রাষ্ট্র বলে, সে কি ফেলানি জানত না?
ফেলানি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে ধিক্কার দিয়েছে, দেশকে নয়। তাই তো মাটির টানে ছুটে আসছিল ১৫ বছরের কিশোরী বউ সাজার স্বপ্ন নিয়ে। দেশে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, তার সে স্বপ্নের কবর রচনা করেছে বন্ধুদেশের শত্রুরা।
ফেলানির লাশ! কবি হাসান হাফিজের লেখা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালির বন্ধু পিরিতির কথা।
কবি হাসান হাফিজের ভাষায়-‘ফেলানির বাবার দীর্ঘশ্বাস আছড়ে আছড়ে হারিয়ে যায় নিষ্ঠুর চরাচরে। বিএসএফ’র নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করেছে বলে শুনিনি। ফেলানির জীবন কিছুতেই ফিরে পাওয়া যাবে না। অন্তত প্রতিবাদটুকু করা হলে আমরা সামান্য হলেও সান্ত্বনা পেতাম।’
ফেলানির লাশ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালির অসহায়ত্বের কথা। ফেলানির ঝুলন্ত লাশ এবং মর্মস্পর্শী মৃত্যু বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীকে ধিক্কার দিয়ে চিনিয়ে গেল কাঁটাতারে ঘেরা সীমানার ভয়াবহতার কথা। ড. তারেক শামসুর রেহমান লিখিত ‘যে মৃত্যু বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধ। এর কিছু অংশ তুলে ধরছি- ‘ফেলানি এ দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা এক কিশোরীর নাম। ঝুলে ছিল লাশ হয়ে, কাঁটাতারের বেড়ায়। ১৪ বছরের ফেলানির বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল পরদিন। কিন্তু বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না ফেলানির। লাশ হয়ে ঝুলে থাকল কয়েক ঘণ্টা। ৮ জানুয়ারিতে লাল পায়জামা পরা লাশ হয়ে ঝুলে থাকা ফেলানির ছবি দৈনিক নয়া দিগন্তে যারা দেখেছেন, তাদের হৃদয় কতটুকু হাহাকার করে উঠেছিল, আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমার চোখে পানি এসেছিল। আমি কেঁদেছি। কেঁদেছি ফেলানির জন্য, আমার মেয়ের মতো যার বয়স। ফেলানি এক টুকরো বাংলাদেশ। বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল ফেলানী।
ফেলানি কোনো লাশের নাম নয়। ফেলানি কোনো ফেলনা নাম নয়। ফেলানি মানে-বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা। ফেলানি মানে একখন্ড সবুজ ভূমি। ফেলানি বাংলাদেশের মানচিত্রের নাম। ফেলানি মানে-রক্তাক্ত জাতির পতাকা। ফেলানি মানে- একটি ছোট দেশ, নাম বাংলাদেশ।
ফেলানির নির্মম হত্যাকান্ডের পরও বিএসএফ’র বর্বরতা থেমে থাকেনি। ১৪ মার্চ ২০০১ বিএসএফ মৌলভী বাজারের চাতলাপুর স্থলবন্দরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে দুই ট্রাক চালক ও এক হেলপারকে নির্মম নির্যাতন করে। ১০ মার্চ ২০১১ চাঁপাইনবাবগঞ্জের পবা উপজেলার খানপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গাড়ি চাপায় ২ বাংলাদেশী নিহত, ১৭ জন আহত হয়। ২৫ মার্চ ২০১১ সব সংবাদ পত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জাতীয় সংসদে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জানান, আওয়ামী মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত (২৬ মাস) বিএসএফ’র গুলি বর্ষণে ১৩৬ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। বিএসএফ’র গুলিতে একই সময়কালে আহত হন ১৭০ বাংলাদেশী। ৬ মে ২০১১ কুড়িগ্রামের রাজীবপুর সীমান্তে আন্তর্জাতিক মেইন পিলার ১০৭৩-এর কাছ থেকে বিএসএফ সদস্যরা রউফ মিয়া নামে এক কৃষককে অপহরণ করে। ৭ মে ২০১১ দিনাজপুর সদর উপজেলার খানপুর গ্রামের ফয়জুর রহমানের ছেলে হাফিজুর রহমানকে (৩০) সুন্দরা বিওপির প্রধান পিলার ৩১৬ এর সাব পিলার-৪ এর বিপরীতে বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে। এর আগে ১৮ এপ্রিল ২০১১ সাতক্ষীরা জেলার গাজীপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে মারা যায় রেকাতুল ইসলাম নামের এক যুবক। ১৬ জুন যশোরের শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা গ্রামের কয়েকজন যুবককে আটক করে বেদম পেটানোর পর বিএসএফ সদস্যরা তাদের শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে পেট্রোল ঢুকিয়ে দেয়, ২৮ জুন ২০১১ মিজানুর রহমান নামে ১৮ বছরের এক যুবককে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। ২ জুলাই সিলেটের ভোলাগঞ্জ সীমান্তে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। ২২ জুলাই ভোরে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঠাকুরপুর সীমান্তে বিএসএফ সেলিম হোসেন (২৫) নামে এক বাংলাদেশী কৃষককে হত্যা করে। ভোরে সীমান্ত সংলগ্ন নিজ জমিতে ঐ কৃষক কাজ করতে গেলে বিএসএফ তাকে পেটাতে পেটাতে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। ২৫ জুলাই বুড়িমারী সীমান্তে রফিকুল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশীকে বিএসএফ ধারাল অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে সানিয়াজন নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। জুলাই ২০১১ মাসে ৩ জন বাংলাদেশী বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়। ২৪ অগাস্ট ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর সীমান্তে বিএসএফ বাবুল হোসেন নামের এক বাংলাদেশীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করে। বিকালে স্থানীয় লোকজন নাগর নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। ১৫ অকটোবর ২০১১ দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে বিএসএফ’র পাথর নিক্ষেপে সুমন (১৫) নামের এক বাংলাদেশী বালক গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনা প্রসঙ্গে সুমনের বড় ভাই বিপ্লব জানায়, তার ভাই যখন সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে দাঁড়িয়ে ছিল তখনই এক বিএসএফ সদস্য তাকে পাথর ছুঁড়ে জখম করে।
১৬ ডিসেম্বর ২০১১ কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি সীমান্তে বিএসএফ’র বোমার আঘাতে আনোয়ার হোসেন (২৭) নামে এক বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে মোহর আলী নামক আরো একজন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৪০ বছর উদযাপনের সময় বিএসএফ’র গুলিতে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহেব বাড়িয়া সীমান্তে নিহত হয়েছে এক বাংলাদেশী। একই দিন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চরগোড়ক মন্ডপ সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশী নাগরিক আহত হয়েছেন। ১৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে আলমগীর হোসেন (২৫) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
সারণী -২
বিএসএফ’র হাতে নিহত এবং আহত বাংলাদেশী নাগরিকদের বছর ওয়ারী হিসাব (২০০২-২০১১
সন নিহত আহত আক্রমণ ও গোলাগুলির ঘটনা
২০০২ ১০৫ ৯৩
২০০৩ ৪৩ ৪৭
২০০৪ ১৩৫ ৯৭
২০০৫ ১০৪ ৯৩
২০০৬ ১৪৬ ১৩৩
২০০৭ ১২০ ১০৩
২০০৮ ৬২ ৪৭
২০০৯ ৯৮ ৭৯ ১০০
২০১০ ৭৪ ৮৭ ৩৭
২০১১ ৭৫ ৬৫ ২৭
তথ্য : বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপস্থাপিত তথ্যানুসারে তৈরি।
সময়ের সাথে সাথে বিএসএফ’র দ্বারা হত্যা-গুম-নির্যাতন বেড়েই চলেছে। এর শিকার হচ্ছেন নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক। অবশ্য অতি সম্প্রতি এক বিজিবি সদস্যও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাকে পিটিয়ে আধমরা করে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি হাবিবুরকে উলঙ্গ করে ৫ ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতনের ঘটনাটি সকলের মনে নাড়া দিয়েছে। বিএসএফ সদস্যরা ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান হাবু নামের যুবকের ওপর যে নারকীয় নির্যাতন চালায় তা বর্ণনা করার মতো নয়। এটি ভারতের এনডিটিভি চ্যানেলে প্রথম প্রচারিত হয়। প্রকাশিত ভিডিওতে দেখতে পাওয়া যায় হাবিবুরকে উলঙ্গ করে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিত্র। এ নির্যাতন দেখে মনে হয় তা গুয়ানতানামো-বে কারাগারের নির্যাতনকেও হার মানাবে। কিভাবে একটি দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী অন্য দেশের নিরীহ মানুষের ওপর এভাবে নির্যাতন চালায়? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ব্যাপারে বলছে, ‘বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর বিএসএফ’র অত্যাচারের যে ভিডিও প্রচারিত হয়েছে, তা অবশ্যই মেনে নেয়ার মতো নয়। সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যে কতটা ব্যাপক, এ ঘটনা তার আভাস মাত্র’।
মুহাম্মদ রেজাউর রহমান লিখেছেন, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ সীমান্তবর্তী এলাকার সকল মানুষকেই সন্দেহের চোখে দেখে এবং মনে করে যে তারা জঙ্গি, চোরাকারবারী বা তাদের সহযোগী। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত নির্মিত কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গাতে গিয়ে বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারায়। তার মৃতদেহ দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকার খবর ভারতীয় ও বিশ্বগণমাধ্যমে প্রচারিত হলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নির্মম বাস্তবতা অসংখ্য ভারতীয় ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর পরই বিশ্ব গণমাধ্যমে গত এক দশকে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশী ভারতীয় বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হওয়ার হিসাব স্থান লাভ করে। ভারতের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘দি হিন্দু’ গত ২৪ জানুয়ারি সীমান্তে বর্বরতা শীর্ষক সম্পাদকীয়তে যে ঘটনার নিন্দা করেছে তা হলো- ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশী এক যুবক হাবিবুর রহমানের নিগৃহীত হওয়ার বিবরণ। যে অমানবিক, অশালীন ও বর্বর পন্থায় বিএসএফ তাকে বিবস্ত্র করে অমানবিক নির্যাতন করেছে, সে ঘটনার ভিডিও এর আগে ইউটিউব এবং এনটিডিটিভিতে প্রচারিত হয়। এগুলো উল্লেখ করে পত্রিকাটিতে লেখা হয় উক্ত বর্বর ঘটনার জন্য ভারতের উচিৎ বাংলাদেশের কাছে নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা। সম্পাদকীয়টিতে ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে তিনজন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার ঘটনারও উল্লেখ করা হয় এবং মন্তব্য করা হয় যে, এসব ঘটনায় বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব বেড়েই চলেছে। বিএসএফ তাদের খেয়ালখুশি মতো নিরীহ ও নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছেন বলেও পত্রিকাটিতে বলা হয়। আরো বলা হয় যে, ২০১১ সালের মার্চে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সীমান্তে বিএসএফ গুলি করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বিএসএফ সদস্যরা তা মানছে না বলে উল্লেখ করে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় যে, বিএসএফ সদস্যদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী যুবক হাবিবুর রহমানকে অমানুষিক নির্যাতন করার পর একাধিক হত্যার ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিংনগর সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী সাজ্জাদ হোসেন বাবুকে অপহরণ করে বিএসএফ জওয়ানরা। অপহরণের ২০ দিন পর বাবুর লাশ পাওয়া যায় পদ্মা নদীতে। তার সারা গায়ে ছিলো অমানুষিক নির্যাতন চিহ্ন। হাত দুটি ছিলো পিছনে বাঁধা।
এ ছাড়া কুড়িগ্রামের ভুরঙ্গামারী সীমান্তে নিহত আরেক বাংলাদেশী যুবক আবদুল লতিফ লেবুর লাশ ৯ দিন পর হস্তান্তর করেছে বিএসএফ।
বিগত ২০ জানুয়ারি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার দলকুইয়া সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় চোরাচালানী শাহ আলমকে হত্যা করা হলে তার সহযোগীরা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের হাবিলদার লুৎফর রহমানকে বিএসএফ’র উস্কানিতে বেধড়ক মারধোর করে এবং তাকে জোরপূর্বক ধরে ভারতীয় এলাকায় নিয়ে যায়। পরে তারা তাকে বিএসএফ’র কাছে হস্তান্তর করে। অপহৃত হাবিলদারকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওইদিনই বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে অধিনায়ক পার্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অপহৃত হাবিলদারকে পরের দিন রাত ৩টার সময় অমানবিক নির্যাতনের ফলে মারাত্মক আহত অবস্থায় ফেরত দেয়া হয়।
ড. কে এ এম শাহাদাত হোসেন মন্ডল লিখেছেন, সম্প্রতি সীমান্তে বাংলাদেশী এক যুবকের ওপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র বর্বর নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হলে তা বাংলাদেশে ব্যাপক নিন্দা ও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। নির্যাতিত বাংলাদেশী যুবকটি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের সতের রশিয়া গ্রামের সাইদুর রহমানের পুত্র হাবিবুর রহমান (২২)। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গত ৯ ডিসেম্বর হাবিবুর রাজশাহী পবা উপজেলার খানপুর সীমান্ত দিয়ে গরু আনার জন্য ভারতে যান। সেখানে গরু না পেয়ে ফিরে আসার সময় ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার রানীনগর ক্যাম্পের বিএসএফ জওয়ানরা রাত ১১টার দিকে তাকে ধরে ফেলে। হাবিবুরের ভাষায়, তার কাছে মোবাইল ফোন সেট, টর্চলাইট ও এক হাজার টাকা দাবি করে বিএসএফ সদস্যরা। এসব দিতে হাবিবুর রহমান অসম্মতি জানালে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ৬/৭ জন জওয়ান তাকে নির্মমভাবে মারধর করে। সকালেও মারধর চলে। এক পর্যায়ে তার পরনের লুঙ্গিও খুলে নেয় তারা। বিএসএফ জওয়ানরা তাকে উলঙ্গ করে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে ও লাথি মারে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে ক্যাম্পের কাছে একটি সরিষা ক্ষেতে তাকে ফেলে রাখে বিএসএফ জওয়ানরা। পরে জ্ঞান ফিরলে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ফিরেন। বাড়িতে এসে গোপনে চিকিৎসা নেন হাবিবুর। তার শরীরে এখনও নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-র পৈশাচিক নির্যাতনের চিত্র এবার খোদ ভারতীয় মিডিয়াতেই প্রচারিত হয়েছে। বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশী যুবককে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে তার ভিডিও চিত্র গত ১৮ জানুয়ারি ভারতীয় টিভি চ্যানেল এনডি টিভিসহ কয়েক টেলিভিশনে প্রচার করা হয়, যার ধারবাহিকতায় তা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়াতে চলে আসে এবং প্রচারিত হয়। এরপর সারা ভারতেও এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ভিডিও চিত্রসহ এ খবরটি বারবার সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া ভারতে বিখ্যাত সংবাদপত্র দি হিন্দু, টাইমসের মত বিভিন্ন পত্রিপত্রিকায় গুরুত্বের সাতে এ খবর ছাপ হয়। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, আটক বাংলাদেশী যুবককে হাত-পা বেঁধে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে বিএসএফ সদস্যরা বেধড়ক লাঠি দিয়ে পেটায়, লাথি মারে, বুকের ওপর বুট দিয়ে চাপ মারতে এবং নিরীহ মানুষের উপর বর্বর নির্যাতন করতে খুব সুখ আনন্দ পায়।
সম্প্রতি প্রকাশিত মানবাধিকার কমিশনের জরিপ রিপোর্টে জানা যায় ২০১২ সালের জানুয়ারী থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়কালে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয় ৩৪ জন বাংলাদেশী। একই সময়কালে বিএসএফ’র আক্রমণে আহত হয়েছেন ৪৮ জন বাংলাদেশী এবং অপহৃত হয়েছেন ২৫ জন। এ হিসাব দিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। ২ জুলাই ২০১২ সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বেড়াগাছী সীমান্তের মেইন ১৩-এর সাব ৬নং পিলারের বিপরীতে বিএসএফ সদস্যরা আলতাফ হোসেন (২৩) নামের এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে পঞ্চা উদ্দিন ঢালি (২৩) নামের আরেক বাংলাদশী আহত হয়। একই দিন বেনাপোলের দৌলতপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে এক বাংলাদেশী নিহত হয়। ১ জুলাই ২০১২ ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার ডাবরী সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে আবু তাহের (২৮) ও এনামূল (২৫) নামে দুই বাংলাদেশী গুরুতর আহত হয়েছেন। একই দিন হরিপুর উপজেলার তিন বাংলাদেশী বশির, রমজান আলী কচু ও গোলাম হোসেনকে বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ৫ জুলাই ২০১২ বিএসএফ শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুর খান সীমান্ত থেকে শফিকুল ইসলাম (৩৮) ও সুব্রত তাঁতী (৩০) নামের দুই বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে গেছে। গত ২ জুলাই ২০১২ কুড়িগ্রাম জেলার নারায়ণপুর সীমান্তবর্তী এলাকায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোঃ জাফর আলী, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক জনাব হাবিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান নাজমুল হোসেনসহ সাত সদস্যের একটি টীম বিএসএফ’র হাতে গ্রেফতার হন। ভারতের মসলাবাড়ি ক্যাম্পের বিএসএফ জওয়ানরা তাদের আটক করে। পরে বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফ’র উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ ও দেন দরবার করার পর তারা ছাড়া পেয়েছেন। বিএসএফ কর্তৃক তাদের গ্রেফতার অত্যন্ত অপমানজনক বলে বিভিনণ প্রিন্ট মিডিয়ায় মন্তব্য করা হয়েছে। ৮ জুলাই ২০১২ দৈনিক ইনকিলাব জানিয়েছে বিএসএফ’র হাতে বিনাদোষে ২০০০ সালের ১১ ডিসেম্বর রাতে আটক কুড়িগ্রাম জেলার ভুরঙ্গামারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের কামাত আঙ্গারীয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনের বড় ছেলে আশিক ইকবাল মিল্টন ভারতীয় কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে জীবনের বারটি বছর কাটিয়ে গত ৭ জুলাই দুপুরে বাংলাদেশে ফিরেছে। মুক্তি পাওয়া মিল্টন জানান, আমার জীবনের ১২টি বছর হারিয়ে গেছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
১.৬ সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা-নির্যাতনের নানাবিধ ভারতীয় কৌশল
বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় লোকজন আরও বেশি ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত ও অনিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করছে। বিএসএফ’র উস্কানিমূলক ও আক্রমণাত্মক কর্মকান্ডে সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতীয় সীমান্ত। বিশাল সীমান্তে মানুষ নানাবিধ সমস্যা মুকাবিলা করে কোন রকমে টিকে আছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, নিরীহ-নিরপরাধ মানুষজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া, গবাদিপশু আটক, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বাড়িঘরে হামলা ইত্যাদি কর্মকান্ড বিএসএফ অবলীলায় করে যাচ্ছে। সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা-নির্যাতনে বিএসএফ বহুবিধ নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এ কৌশলগুলো নৃশংস, পৈশাচিক, বর্বর ও অমানবিক।
ভারতীয় বিএসএফ’র হত্যা-নির্যাতনের কৌশলগুলো নিম্নরূপ :
১. বাংলাদেশীদেরকে পাখির মত নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা/খুন,
২. কুপিয়ে হত্যা,
৩. শ্বাসরোধ করে হত্যা,
৪. সীমান্ত নদীতে ডুবিয়ে হত্যা,
৪. পাথর ছুড়ে আহত করা ও হত্যা করা- বোল্ডার নিক্ষেপ করে অজ্ঞান করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া।
৫. বেদম পিটানো- কাঁটা তারের বেড়ার সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে মারপিট-পিটিয়ে হত্যা,
৬. বোমা নিক্ষেপ করে হত্যা,
৭. তীর, ধনুক নিক্ষেপ করে আহতকরণ ও হত্যা,
৮. মারপিটের পাশাপাশি নিতম্বে ইনজেকশন পুশ করা। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে পেট্রোল ঢুকিয়ে দেয়া। এর ফলে অসহ্য যন্ত্রণার শিকার হন বাংলাদেশীরা,
৯. বৈদ্যুতিক শক দিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা। গোপন অঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেয়া,
১০. বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা,
১১. ধর্ষণ- সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশী গৃহবধু নারী ও কন্যা শিশুরা বিএসএফ ও ভারতীয়দের ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিবাদ করায় স্বামীকে হত্যা করা হচ্ছে,
১২. বিএসএফ’র গাড়িচাপায় বাংলাদেশী হত্যা,
১৩. হাত পায়ের রগ কেটে সীমান্ত সংলগ্ন নদীতে ফেলে দেয়া,
১৪. স্পীড বোটের ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশীদের হত্যা-সীমান্ত নদীতে বাংলাদেশী অংশে মাছ ধরার সময় স্পীড বোটের ধাক্কা দিয়ে বহু বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে।
১৫. সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ,
১৬. সীমান্তে সার্বক্ষণিক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা,
১৭. যখম-আঘাতে আঘাতে নিহত বাংলাদেশীদের পাওয়া যাচ্ছে,
১৮. খুনের পাশাপাশি বিএসএফ অপহরণের পথও বেঁছে নিয়েছে,
১৯. লুট ও ছিনতাই এর অসংখ্য ঘটনা ঘটছে,
২০. ধারাল অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে সীমান্ত নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া,
২১. পানিতে ডুবিয়ে নির্মম নির্যাতন,
২২. ধরে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে হত্যা করা,
২৩. মর্টার নিক্ষেপ, প্যারাসুট সেল নিক্ষেপ করে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়া ও আতংক সৃষ্টি করা,
২৪. বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের জন্য সীমান্ত জুড়ে শত শত ফেনসিডিল কারাখানা স্থাপন করেছে। এ মাদক দ্রব্য বাংলাদেশে চোরাচালানের ফলে এদেশের লাখ লাখ যুবক মাদকাসক্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,
২৫. পণ্যবাহী ট্রাক চালকদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এইডস ছড়ানোর ঝুঁকি,
২৬. বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে গিয়ে যৌনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে অভিনব কায়দায় নির্যাতন,
২৭. নির্যাতিতরা করুণা চায়, করুণার বদলে বিএসএফ ও ভারতীয়রা হাসি, ঠাট্টা, তামাশা, বিদ্রুপ ও উল্লাস প্রকাশ করে,
২৮. সীমান্ত নদীতে টহল গান বোট থেকে ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশী যাত্রীবাহী নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা।
প্রতিবেশী দেশের সাধারণ মানুষকে সীমান্তে পেলেই গুলি করে মেরে ফেলা কিংবা অন্যকোনভাবে হত্যা করার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। হত্যা হত্যাই। সেটা যেভাবেই ঘটুক। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে বাংলাদেশীরা বিএসএফ’র আগ্রাসনের শিকার হয়নি। তাদের সময় কাটে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর মৃত্যুর বিভিষিকার মধ্যে।
১.৭ সীমান্ত সন্ত্রাসের বিরোধিতা খোদ ভারতেই
সীমান্তে বিএসএফ’র সন্ত্রাস হানাদারি নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভারতের তরফ থেকে বারবার আশ্বাস দেয়ার পরও ভারতীয় এই বাহিনীর সন্ত্রাস অব্যাহত আছে। বিএসএফ সদস্যদের অমানবিক আচরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন খোদ ভারতের দু’জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁদের মতে, এটি একটি জঘন্য অপরাধ এবং চরম লজ্জাজনক। প্রতিবেশী দেশে এই ঘটনায় ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষ বাড়বে। এতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হবে। কয়েকজন বিএসএফ জওয়ানের জন্য এ ধরনের সম্পর্কের প্রভাব খুবই আশঙ্কার বিষয়। এখনই দ্রুত এ রকম ঘটনা রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হবে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের কারণ। তিনি বলেন, বিএসএফ’র নির্যাতনের ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখে লাভ নেই। মাঝে মাঝে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এটা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এই ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কোন রেখাপাত করবে না।
সুখের বিষয় এই যে, সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে কিছু কিছু ব্যতীক্রমধর্মী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো কোনো সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল কোদালকে কোদাল রূপেই আখ্যায়িত করছেন। এরই সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো এনডিটিভিতে বাংলাদেশী তরুণ হাবিবুর রহমানের ওপর অমানুষিক নির্দয় নির্যাতনের ভিডিও প্রচার ও দি হিন্দু সংবাদপত্রটি কর্তৃক এ সম্বন্ধে প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশ। ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশী তরুণের ওপর নৃশংস নির্যাতনের প্রচার এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রেখা বরাবর নির্মিত কাঁটাতারের বেড়াকে ‘মৃত্যুর দেয়াল’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রেক্ষিতে ও সীমান্তকে বন্ধুত্বের সীমান্ত হিসেবে গড়ে তোলার সিংহভাগ দায় বর্তায় ভারতেরই ওপর।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় বিএসএফ প্রধান ইউকে বনশাল মন্তব্য করেছে, ‘সীমান্তে গুলি চালানো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।’ পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিএসএফ’র প্রধানের এ মন্তব্যে অতি উৎসাহিত হয়েছে বিএসএফ’র আগ্রাসী সদস্যরা। বস্ত্তত বনশালের মন্তব্যে ভারতীয় ছিটমহলের নাগরিকরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশী নাগরিকরাও নতুন করে ভারতীয় আগ্রাসী বাহিনী বিএসএফ’র গুলিতে হত্যার আশঙ্কায় নিরাপত্তাহীনতায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। গত কয়েক দিনে বিএসএফ বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি চালিয়ে হত্যা না করলেও সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাটের বিভিন্ন সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে, সেসব ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক। আমাদের বিজিবি অপহরণ করা বাংলাদেশী নাগরিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চাওয়ার পরও বিএসএফ সদস্যরা তাদের ফেরত না দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় থানাগুলোতে।
গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমহোন সিং বাংলাদেশ সফরে এসে আমাদের শুনিয়েছিলেন, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ) এখন থেকে সীমান্তে আর গুলি করবে না। এর আগে গত বছরের ৩০ জুলাই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ঢাকায় উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রমকালে বিএসএফ কাউকে আর গুলি করবে না। তিনি সে সময় আরো জানিয়েছিলেন বিএসএফকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে কোনো অবস্থাতেই গুলি করা যাবে না, শেষ জওয়ানটির কাছেও এ বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আশ্বাসগুলো যে ছিল শুধুই ধোঁকাবাজি তা গত ডিসেম্বরে ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম রামচন্দনের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি না চালাতে বিএসএফকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি না চালাতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে কোনো নির্দেশ দেয়া হয়নি। তার এই
মন্তব্যের পর ভারতীয় গণমাধ্যম ‘আসাম ট্রিবিউনে’ বক্তব্যটিকে ‘ইন্টারেস্টিং’ অভিহিত করে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় প্রতিশ্রুতির পুরোটাই প্রহসন। ভারত আগাগোড়াতেই বাংলাদেশকে দেয়া কোনো অঙ্গীকার রক্ষা করছে না।
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি কিছুদিন আগে পেট্রাপোল সীমান্তে এসেছিলেন। সেখানে তিনি দোষারোপ করেছেন গণমাধ্যমকে। বলেছেন, সীমান্তের ঘটনাগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। প্রণব মুখার্জির এ ধরনের মন্তব্য মোটেও ঠিক নয়। শুধু বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যম নয়, বিএসএফ’র মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকান্ড ভারতীয় প্রচার মাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত ফেলানির লাশ কিংবা ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বাংলাদেশী যুবকের নির্যাতনের ছবিগুলোও কি মিথ্যা? ভারত চাওয়া মাত্রই বর্তমান সরকার সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে, প্রতিদানে আমরা পাচ্ছি কাঁটাতারে ঝুলন্ত কিশোরী ফেলানির লাশ ও উলঙ্গ দেহ ফেরৎ নির্যাতিত যুবক হাবুকে। ভারত বাংলাদেশের প্রতি বৈরী মনোভাবে ও বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে।
ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রধান সাবেক বিচারপতি কেজি বালাকৃষ্ণাণ বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি মর্যাদা দিয়ে বিএসএফকে বাংলাদেশ সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ করতেই হবে। তিনি বিএসএফকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। ভারতীয় সাংবাদিক যতীন দেশাই বলেছেন, সীমান্তে যে কোন হত্যা নিন্দনীয়। পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও একসময়ের রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী কমলগুহ বলেছেন, সীমান্তে বিএসএফ জঘন্য অত্যাচার করছে। কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানীর লাশের ছবি ছাপা হয় আনন্দ বাজার পত্রিকায়। নীচে লেখা ছিল সম্প্রতি বিএসএফ’র গুলিতে নিহত ফেলানীর লাশ।
১.৮ বিশ্বব্যাপী সীমান্তে ভারতীয় সন্ত্রাসের নিন্দা
বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক ব্রাড অ্যাডামস গত ২৩ জানুয়ারী ২০১১ তার এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে দক্ষিণ এশিয়ার বধ্যভূমি- মৃত্যু উপত্যকা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেছেন এ সব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র হাতে। তিনি বিএসএফকে ঠান্ডা মাথার খুনি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত গুলি করে হত্যার নীতি নিয়েছে এবং এই সীমান্তকে দক্ষিণ এশিয়ার বধ্যভূমি বানানো হয়েছে। যার ফলে নিহতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বিরাট আকার ধারণ করছে।
সম্প্রতি উইকিলিকস বলেছে- বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতিনিয়ত বিএসএফ ও পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। কিন্তু তাদের বিচার হচ্ছে না। বিএসএফ’র মত বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত কোন অপরাধের তদন্তের জন্য ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনুমোদন লাগে। কিন্তু সে অনুমোদনের ব্যাপারটা সচরাচর দেখা যায় না। ..... গরিব, নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে গুলি করে নিয়মিতভাবে হত্যা করা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের আচরণ হতে পারে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠককালে সীমান্ত হত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিএসএফ’র নির্যাতনের বিচার চেয়েছে। ৩১ জানুয়ারী ২০১২ প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, ভারত সরকার বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ’র হত্যা এবং নির্যাতনের ব্যাপারে ভালোভাবেই অবগত। কিন্তু দোষীদের কখনোই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বাংলাদেশী যুবক হাবিবের ওপর নির্মম নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের পর পরীক্ষা হয়ে যাবে ভারতের আইন-শৃংখলা বাহিনী আইনের ঊর্ধ্বে কিনা? হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, ‘মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছে, বিএসএফ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। লাগামহীন অত্যাচার-নিপীড়নের এ চিত্র ভিডিওতে উঠে আসায় সে বিষয়টিই প্রমাণিত হয়েছে।’ ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতাভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এবং ঢাকা ভিত্তিক সংস্থা অধিকারকে সঙ্গে নিয়ে ‘ট্রিগার হ্যাপি : এক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্টুপস অ্যাট দা বাংলাদেশ বর্ডার’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে (এইচআরব্লিউ)।
ভারত সরকারই চায় না সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর বিএসএফ’র নির্যাতন বন্ধ হোক। যদিও বারবার ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি বাংলাদেশী চোরাকারবারিকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র প্রকাশের ঘটনায় যে আট বিএসএফ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না। ফৌজদারি কার্যবিধিতে কোন অভিযোগও উত্থাপন করা হবে না। যদিও ঘটনা তদন্তে
আন্ত:বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত ‘কিভাবে বিএসএফ’র নির্যাতনের ভিডিওচিত্র প্রকাশিত হল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের মানবাধিকার সংস্থা বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে ভারতীয় মানবাধিকার কর্মী মাসুমের সেক্রেটারী কৃতী রায়ের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, একটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে বলে ঘটনার সংখ্যা যে একটি তা নয়, বরং হরমামেশাই বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর এমন বা তার চেয়ে কঠোর নির্যাতন চালায়। আর সত্য হচ্ছে, ভারত নির্যাতনকারী বা হত্যাকারীর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ই না।
কানাডাসহ কয়েকটি দেশ বিএসএফ কর্মকর্তাদের ভিসা নাকচ করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে, যদিও তাদের একজন নাগরিকও বিএসএফ-’র গুলিতে মারা যায়নি।
১.৯ সীমান্ত সন্ত্রাস : বাংলাদেশ ভারতের টার্গেট কেন?
ভারতীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতনের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা কেন বেড়ে যাচ্ছে, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সীমান্তে গুলি বন্ধ হবে না বিএসএফ প্রধানের এমন আগ্রাসী মন্তব্যের পর কোনো অফিসিয়াল চিঠি দেয়নি বা দিচ্ছে না বাংলাদেশ।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত এক দশকে বিএসএফ নয় শতাধিক বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে। এতে বলা হয়েছে, সীমান্তে হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই দায়মুক্তির ব্যবস্থা বাতিল করে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী বিএসএফ সৈন্যদের বিচার করার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বিএসএফকে ট্রিগারহ্যাপি ও নিয়ন্ত্রণহীন দাবি করে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন যেকোনো ব্যক্তির ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে এই বাহিনীকে। যাদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে তারা দোষি না নির্দোষ তা সামান্যতমও আমলে নেয়া হবে না। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের মানুষ বিএসএফ’র মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের শিকার হচ্ছে বলে এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন বিএসএফ’র নির্বিচারে হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সোচ্চার তখন বাংলাদেশের সরকার তার নাগরিকদের রক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার নয়। অন্যায়ভাবে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ব্যাপারে সামান্যতম প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারছে না। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি এমনকি প্রধানমন্ত্রী যখন ভারত সফরে ছিলেন তখনো বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। ভারতের প্রতি কোন দায় থেকে সরকার তার নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদ করতে পারছেন না তা স্পষ্ট নয়। তবে এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে সরকার শুধু তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে না- দেশের সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না।
সাধারণভাবে ভারতের উপাধি হলো ‘বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী’। সম্মানজনক উপাধিই বটে। একজন ইংরেজ কবি সুন্দর বলেছেন, ‘Friendship may grow into love but love never subsides into friendship’ বন্ধুত্ব থেকে ভালবাসা গড়ে ওঠে কিন্তু ভালবাসা থেকে আর বন্ধুত্বে ফিরে যাওয়া যায় না অর্থাৎ ভালবাসা ভেঙ্গে গেলে যা হয় তা হলো, অনিবার্য অসুখ, অনিবার্য বিবমিষা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির কথা ভারত-বাংলাদেশ উভয়েরই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মনে রাখা উচিত। এই সেই ভারত যে কাঁটাতার দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে ঘিরে (পড়ুন, আবদ্ধ করে) রেখেছে। মানুষ তো দূরের কথা, অবলা গরু-ছাগলেরও সুযোগ নেই ভারতীয় বেড়া ডিঙানোর। তারপরও সীমান্তে এতগুলো বাংলাদেশীকে আহত-নিহত হতে হচ্ছে কেন? সীমান্তের কাছে কোনো নাগরিক তো অস্ত্র নিয়ে যায় না। ভারতীয় পক্ষের প্রতি এমন কোনো আচরণ করে না, যার জন্য গুলি ছুড়তে হবে? নিরীহ সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার আরেক নাম বর্বরতা। বর্বরতা আর বন্ধুপ্রতিম শব্দ দুটি এক সঙ্গে ব্যবহার করা যায় না। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও কী সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে এত মানুষ মারা হয়? ‘পাখির মতো গুলি করে’ উদাহরণটা গ্রহণ করেছি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম থেকে। এদেশের প্রায় সব পাঠকই এর সঙ্গে পরিচিত। কারণ সীমান্তে পাখি শিকারের মতো মানুষ শিকারের বিষয়টি আকসার পত্রিকায় ছাপা হয় এবং তখন উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যার বিষয়টি।
বাংলাদেশ ছাড়া এমন হত্যাকান্ড ঘটে একমাত্র ফিলিস্তিনে, যেখানে যায়নবাদী ইসরাইলিরা মুসলিমদের ‘পাখির মত গুলি করে’ হত্যা করে। ইসরাইল তো ফিলিস্তিনের শত্রুরাষ্ট্র, সেখানে হত্যা-পাল্টা হত্যা চলতেই পারে। দেশ দুটি পরস্পরে অলিখিত যুদ্ধে জড়িত। ভারত তো আমাদের শত্রুরাষ্ট্র নয়- ‘বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র’। তাহলে এখানে হত্যার বিষয় কেন।’ কার্যত ভারতীয় পক্ষের আচরণ অবন্ধুসুলভ এবং আগ্রাসী। বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সীমারেখা বা সীমানা থাকে। এই সীমারেখা বা সীমানার উভয় পাশের দেড়শ গজ ভূমিকে চিহ্নিত করা হয় নোম্যানস ল্যান্ড হিসেবে, যার ওপর কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা চলবে না এবং যেখানে কোনো ব্যক্তি অনুমতি বা পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া দাঁড়াতে বা অবস্থান করতে পারবে না। স্থলপথে এক দেশ থেকে অন্যদেশে যাতায়াতের জন্য সংশ্লিষ্ট দুটি দেশের স্বীকৃত স্থলবন্দর বা ইমিগ্রেশন স্টেশন থাকে। সেই স্থল বন্দর দিয়ে পূর্ব অনুমতি ভিসাসহ বা ভিসা ছাড়া অন্য কোনো দলিলের ভিত্তিতে লোকেরা শুধু যাতায়াতের সুযোগ পেয়ে থাকে। ভারতের সাথে বিশাল স্থল সীমার (৩,৯৩৩ কিলোমিটার, ২২৩ কিলোমিটার নৌসীমা, ৩৬ কিলোমিটার অচিহ্নিত এবং সমুদ্র সীমানা অচিহ্নিত) মধ্যে উভয় দেশের স্বীকৃত বেশক’টি স্থল বন্দর বা ইমিগ্রেশন স্টেশন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী সীমারেখার উভয় পাশের দেড়শ’ গজের মধ্যে কোনো দেশই কোনো ধরনের স্থাপনা বা সড়ক নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু ভারত সেদেশে অবৈধভাবে বাংলাদেশীরা প্রবেশ করছে এ অভিযোগে অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় নোম্যান্স ল্যান্ডের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছে। এসবের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা চৌকি, টাওয়ার, কাঁটাতারের বেড়া এবং পাকা রাস্তা। এছাড়াও শুধু হত্যা ও আহত করাই নয়, বিএসএফ বরাবরই সীমান্ত আইন লংঘন করে নানা ধরনের দুষ্কর্মে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ভূখন্ডে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে চাষাবাদ, সীমান্ত পিলার ভাঙ্গা, নদী থেকে জোর করে মাছ লুট, বাংলাদেশ এলাকার নদীতে জেগে উঠা চর জবরদখল ইত্যাদি অনৈতিক কাজে বিএসএফ লিপ্ত রয়েছে।
সম্প্রতি তার আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সীমান্ত এলাকায়। সারাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি উৎসব করছে, ঠিক সেই সময় চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছে আখাউড়া সীমান্তবর্তী মুগদা ইউনিয়নের মানুষ। আখাউড়া স্থলবন্দরের ঠিক দক্ষিণ পাশে জিরো পয়েন্টে রাস্তা নির্মাণ শুরু করেছে বিএসএফ। স্থানীয় বিজিবি জওয়ানরা বাধা দিলে বিএসএফ জানায়, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তারা রাস্তা নির্মাণ করছে। বিজিবি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তখন পর্যন্ত কোনো সিগন্যাল না পেয়ে রাস্তা নির্মাণের কাজ বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
বিডিআর ম্যাসাকারের পর অনেক দিন পর্যন্ত তো সীমান্তে বাংলাদেশের কোনো প্রহরা ছিলো না। অরক্ষিত সীমান্ত তখন নাকি এককভাবে সামাল দিয়েছে বিএসএফ। সামাল দিয়েছে এবং সঙ্গতভাবেই বলা যায় সীমান্তে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। যার পরিণতিতে আজ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ভূখন্ডের অভ্যন্তরে তাদের বেপরোয়া অনুপ্রবেশ। সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত তারা দখলে নিয়েছে। সেখানে তাদের প্রহরায় ভারতীয়রা বাংলাদেশ ভূখন্ডের প্রায় তিনশ একর জমির ধান কেটে নিয়ে গেছে। ওদের প্রতিরোধ করতে পারেনি বাংলাদেশ, রক্ষা করতে পারেনি নিজের জমির ধান। এর বিরুদ্ধে সরকারিভাবে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, এমনটিও শুনিনি।
প্রতিবাদ জানানো হয়নি ফেলানীর নির্মম হত্যাকান্ডের। শুধু দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই হত্যাকান্ডের প্রতি ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, ভারত এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য সতর্ক থাকার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারপরও ঘটনা ঘটছে। ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শাহজাহান রাশুকে। সার্বিক পরিস্থিতিতে এই সত্যই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারতের এসব তৎপরতার কাছে বাংলাদেশ আজ বড় অসহায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনীতিক এবং বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা একটি আওয়াজ দিচ্ছেন- তারা ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।
এই বন্ধুত্বেরই মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এই বন্ধুত্বেরই মূল্য দিয়ে গেল ফেলানি। এই বন্ধুত্বের মূল্য দিতেই ভারতের আধিপত্যের কবলে আজ বাংলাদেশ। জন্মগত দায় পরিশোধে আজ ভারতের কাছে বাংলাদেশ নতজানু। মাথা উঁচিয়ে ভারতের কোনো অপকীর্তির প্রতিবাদ জানাবার ক্ষমতাও বাংলাদেশ আজ হারিয়ে ফেলেছে।
ভারতের সাথে সাতটি দেশের যেমন : চীন, মায়ানমার, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভূটান, নেপাল, বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া অন্যসব দেশের সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে মানুষ মারতে সাহস পায় না। কই সেগুলোতে তো অপরাধী দমনে গুলি চালানোর কথা শোনা যায় না। শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালাচ্ছে বিএসএফ। বাংলাদেশের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির কারণে প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশীকে বিএসএফ গুলি করে ও নির্যাতন করে মারতে সাহস দেখাচ্ছে। এসব ভারতের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
তাছাড়া ভৌগোলিক গঠনগত অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অবস্থান রয়েছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশের রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক এবং জাতিগত অবস্থানের দিক। এসব ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যমান একটি অবস্থান রয়েছে যা ভারতের ভয়ের কারণ। বাংলাদেশের পশ্চিম দিকে রয়েছে ভারত এবং পূর্বদিকেও ভারত। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার। আর উত্তরে হিমালয়ের সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গ। এ পর্বতমালার এক পাশে রয়েছে ভূটান, নেপাল, সিকিম আর অন্য প্রান্তে রয়েছে গণচীন। আরও রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এই প্রতিটি দেশ খুব সন্নিকটবর্তী।
বাংলাদেশ থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ১৮ মাইল, ভূটানের ৪৫ মাইল এবং চায়নার বর্ডার বড়জোর ৪০-৪৫ মাইল হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ, আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা শুরু সমুদ্রের জলরাশি দিয়ে। আমাদের এসব ‘স্ট্র্যাটেজিক’ দিক থাকা, এজন্যই আমরা বলি বাংলাদেশ হলো দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগস্থল। আমাদের এ উক্তি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়েছে। আর এজন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ভারতের এক নম্বর টার্গেট। এজন্য ভারত সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমাদের আবদ্ধ করে ফেলছে এবং আমাদের কব্জা করে রাখছে।
ভারতের ভয় হলো গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান ও ‘স্ট্র্যাটেজিক’ কারণে এবং বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামী ভূমিকা ও ঐতিহ্যের কারণের সঙ্গে যদি সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব যোগ হয়, তাহলে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ জেগে উঠবে। এসব ভয় থেকেই ভারত সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে।
১.১০ উপসংহার ও সুপারিশমালা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ একাধিকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। বর্তমানে বিএসএফ কর্তৃক নাশকতামূলক কর্মকান্ড রীতিমতো অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম. ফজলুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আসলে একটি মৃত্যুপ্রাচীর। এটি বিদেশী পত্রিকার ভাষ্য। ভারত সরকারের সম্মতিতেই সীমান্তে হত্যা চলছে।
বাংলাদেশের মানুষের ওপর একটি মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত এটা করছে। ভারতের ধারণা, এভাবে একের পর এক হত্যার কারণে একদিন বাংলাদেশের মানুষ মনে করবে সীমান্তে যা হচ্ছে তা আমাদের নিয়তি। আর তাহলে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। তখন বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ থাকবে, আর সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে এ সম্ভাবনা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ভারতীয় পণ্য বর্জনসহ সব ধরনের প্রীতি আয়োজন বন্ধ করা উচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়া বা করুণার দান নয়। তাই আজকের এই কঠিন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে সচেতন দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐকমত্য প্রদর্শন করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সকল প্রকার অনিয়ম ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এ বিষয়ে সুপারিশ সমূহ নিম্নরূপ ’’
১. আসলে ভারতকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। ভারতের সাথে সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সৎ মানসিকতার কোন অভাব নেই বাংলাদেশের। কিন্তু ভারতের তেমন মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় না। শুধু সীমান্তে বর্বরতাই নয়, তিস্তার পাটি বণ্টন, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, টিপাইমুখ বাঁধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এটি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, ভারত বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছে না। তারপরও বাংলাদেশবাসী আশা করবে, ভারত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মেনে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে।
২. আমরা মনে করি, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যাকান্ড, নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে এদেশের নাগরিকদের রক্ষার জন্য সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো দরকার। একই সাথে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে আরো সক্রিয় করা দরকার। তাদের সামনে সীমান্ত পরিস্থিতি তুলে ধরতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এ ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধে ভারতের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা সম্ভব হয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র যত বড় ও শক্তিশালী হোক না কেন এ ধরনের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করা সংবিধান, মানবাধিকার এবং নৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত জরুরী। এ দেশের মানুষ দেশের সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার গঠন করে থাকে, নিজ দেশের বিরুদ্ধে অন্যায় কর্মকান্ডে নীরব থাকার জন্য নয়।
৩. সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে বাংলাদেশী নাগরিকদের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে কাজ করতে যাওয়া বন্ধ হবে।
৪. বাংলাদেশের নিজস্ব কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার একমাত্র চাবিকঠি হল রাষ্ট্রটির মর্যাদাবোধ, নৈতিক অনুভূতি, জাতীয় চেতনা ও সাহসী ভূমিকা নেয়া। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণে কৌশলসমূহ এসব চাবিকাঠির আলোকেই নির্ধারণ করতে হবে।
৫. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে বাংলাদেশের পক্ষে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সীমান্তে মানবাধিকার লংঘনকারী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের বিষয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন সহযোগিতা লাভে বাংলাদেশকে সফল হতে হবে।
৬. দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতের দাদাগিরিই বড় বাধা। ভারত উচ্চাকাঙ্ক্ষায় সুপার পাওয়ার সুলভ দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী, আচরণ ও প্রবণতা সুবন্ধুসুলভ বা সৎপ্রতিবেশীসুলভ নয়। ভারতকে তার মনোভাব পাল্টাতে হবে। আস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে বড় দায়িত্বটি পালন করতে হবে বড় দেশ হিসেবে ভারতকেই। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মানুষ যুগ যুগ ধরে শান্তি ও সমৃদ্ধির যে আকাঙ্ক্ষা লালন করে আসছে তা পূরণের জন্যই এ ভাবনা আজ জরুরী।
৭. সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা বন্ধে ভারতকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৮. অন্ধ ভারত প্রীতি একটি ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গী। এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
৯. ২০০১ সালে পাদুয়া ও বড়াইবাড়ী যুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসী অনুপ্রবেশকারী বাহিনীকে সমূলে পরাজিতকারী বীরদের বীরোচিতভাবে জাতীয় খেতাবে ভূষিত করে বীরের আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে এবং ১৫ এপ্রিলকে পাদুয়া পুনরুদ্ধার দিবস এবং ১৮ এপ্রিলকে জাতীয় সীমান্ত রক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে দিন দুটিকে জাতীয় ভাবে পালন করতে হবে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, যে দেশে বীরকে সম্মান দেয়া হয় না, সে দেশের বীরের জন্ম হয় না।
১০. ভারতের সচেতন নাগরিকদের মাঝেও সীমান্ত সন্ত্রাস নিয়ে তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতি (Pulse) অনুধাবন করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পানি ও সীমান্তসমস্যাসহ সকল সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে অতিদ্রুত সম্মানজনক সমাধান করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ভারত ভালোভাবে জানে, বাংলার মানুষ ৭১-এ বুকের রক্ত দিয়ে যে দেশ স্বাধীন করেছে ৭১-এর চেয়ে শতগুণ বেশি রক্ত দিয়ে হলেও ভারতীয় পানি আগ্রাসনে সৃষ্ট মরুকরণের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করবে। রক্ষা করবে বাংলার ১৫ কোটি মানুষকে আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়া এবং পথের ফকিরে পরিণত হওয়ার হাত থেকে। বাংলাদেশের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে ভারতীয় নিষ্ঠুর ও অমানবিক পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যাতে রুখে দাঁড়াতে এবং প্রয়োজনে যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে না পারে সে জন্য সীমান্ত সস্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মনোবল ভেঙে দেয়ার এক দীর্ঘ মেয়াদী ও সুদূরপ্রসারী আগ্রাসী পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। এ শিক্ষা ভারত পেয়েছে বিশ্ব আগ্রাসনের গুরু ইসরাইলের কাছ থেকে। কিন্তু ভারতের জানা উচিত বাংলাদেশ প্যালেস্টাইন নয়। বাংলাদশের জনসংখ্যার ১৫ কোটির মধ্যে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান মিলে সাড়ে চৌদ্দ কোটি মানুষ বাঙালি। তন্মধ্যে ১৩ কোটি মানুষ মুসলিম। এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক ধর্মবিশ্বাস এবং এক জাতি। আমরাই পারি নিজের শক্তিতে নিজেকে এবং নিজের দেশকে রক্ষা করতে। আমরাই ভারতকে পরাজিত করেছি পাদুয়া এবং বড়াইবাড়িতে। প্রয়োজনে ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে দেশ, জাতি এবং ধর্ম বাঁচাতে আবারো ৭১-এর অবতারণা করবো ইনশাআল্লাহ। জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এই অধিকার আমাদের বিশ্ব সভায় স্বীকৃত।

লেখক-পরিচিতি : ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম। বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
লেখা পরিচিতি : প্রবন্ধটি ২৮ জুলাই, ২০১২ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসাবে পঠিত হয়।

 

 

 

ফুটনোটঃ

. উদ্ধৃত ড. এমাজউদ্দিন আহমদ, আঞ্চলিক সহযোগিতা জাতীয় নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, এশিয়া পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ডিসেম্বর, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৮৮।
. মহিউদ্দিন আহমদ, এশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৮ জুন ২০১২, পৃ.-৬। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এক, তাহলো-চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থানকে ঠেকানো এবং চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এজন্য ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী শক্তি।
. আজিজুল হক বান্না, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম, সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৮, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, নভেম্বর ২০০৮, পৃ-৪৪।
. মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত মাত্র ১৭৬ মাইল।
. বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, কতলোক মারা গেছে মুক্তিযুদ্ধে? আমি তাঁকে (শেখ মুজিবুর রহমান) বলেছিলাম, হতাহতের কোন হিসাব কেউ রাখেনি, রাখা সম্ভবও ছিল না। তবে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর এবং বিভিন্ন জনের বাচনিক বিবরণ থেকে মনে হয় লাখ তিনেক লোক মারা গেছে, আমরা মিডিয়াকে সর্বশেষ সে হিসেবই দিয়েছি। অন্য কোন মহল থেকে তিনি ভিন্ন হিসেব পেয়েছিলেন? নাকি মানসিক ক্লান্তি, আবেগের আতিশয্য ইত্যাদি কারণে ‘লাখে’ আর ‘মিলিয়নে’ তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন! কারণ যাই হোক পরে ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধে তিন মিলিয়ন (৩০ লাখ) বাংলাদেশী মারা গেছে। - দেখুন সিরাজুর রহমান, একজীবন এক ইতিহাস ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ২০১০ , পৃ. ১৭৬।
. মর্জিনা আফসার রোজী, সীমান্ত এখন রক্তাক্ত প্রান্তর, দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৮।
. দৈনিক ইনকিলাব, ১৮ অগাস্ট ১৯৯৯ সংখ্যা।
. সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের বহুল আলোচিত পাদুয়া গ্রাম ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর দখল করে নিয়েছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ। -দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১০, পৃ-১।

. প্রফেসর ডা. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও বহির্বিশ্ব, ১৯৯৪, পৃ-১২।
. ড. মোহাম্মাদ আব্দুর রব, বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন : বিপন্ন সার্বভৌমত্ব, দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ এপ্রিল ২০০৫, পৃ-৬।
. মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ভারত কোনভাবেই বাস্তবায়ন করতে চায়না বরং জীইয়ে রেখে বাংলাদেশের ওপর উৎপাত চালিয়ে যেতে চায়।
. মনুসংহিতা বা মনু স্মৃতি () সনাতন হিন্দু আইন বা প্রাচীন আইন প্রণেতা মনু ও অন্যান্য ধর্মগুরু কর্তৃক আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ২০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে রচিত। এতে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে যাবতীয় নিষেধ সহ বহুবিধ বিষয়ে ইতিকর্তব্যের নির্দেশ পাওয়া যায়। এ গ্রন্ধের বহু টীকা ও ভাষ্য আছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত ‘মনুসংহিতা’ ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত গ্রন্থ। মনুসংহিতাকে ধর্মশাস্ত্রও বলা যায় আবার স্মৃতিশাস্ত্ররূপেও উল্লেখ করা যায়। সুপ্রাচীন বৈদিক যুগ থেকেই মনুসংহিতার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তা থেকে এ গ্রন্থের প্রাচীনত্বই প্রমাণিত হয়। -দেখুন, মনুসংহিতা, প্রমানেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শাস্ত্রী, সদেশ, বিবেকানন্দ রোড, কোলকাতা।
. অব. মেজর জেনারেল আ.ল.ম. ফজলুর রহমান, ভারতীয় সীমান্ত সন্ত্রাস : কিসের আলামত, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৩ মার্চ ২০০৫, পৃ-৯।
. আবু জাফর, ভারত প্রেমের অমৃত কথা, উপসম্পাদকীয়, দৈনিক ইনকিলাব, ২৬ নভেম্বর, ২০০৪, পৃ-১১।
. সিরাজুল হোসেন খান, সীমান্ত তস্করদের জওয়াব দিচ্ছে বিডিআর, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৮ মার্চ ২০০৫, পৃ-৮।
. ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনা, বজরং, আর এসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বিজেপি’র সাথে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠাতে দাবী জানায়। -দেখুন, দৈনিক সংগ্রাম, উপসম্পাদকীয়, ৯ মে, ২০০১, পৃ-৪।
. সিরাজুল হোসেন খান, পূর্বোক্ত, পৃ-৮।
. সিরাজুর রহমান, তৃতীয় সালতামামিতে হাসিনার ভাষণ হাস্যকর, দৈনিক আমার দেশ, ১১ জানুয়ারী ২০১২, পৃ-৬।
. এডভোকেট বাবুল দে, সৎ প্রতিবেশী পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়, দৈনিক ইনকিলাব, ১৩ জানুয়ারী ২০১২, পৃ-১১।
. মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৭।
. মোহাম্মাদ আবদুল সেলিম, বিএসএফের নিষ্ঠুরতার কাছে সবই যেন হার মেনেছে, দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৫।
. বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সীমান্ত হত্যা, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জানুয়ারী ২০১২, পৃ-৪।
. দৈনিক আমার দেশ, ৬ মার্চ ২০১১, পৃ-৪।
. উদ্ধৃত ড. কে.এ.এম. সাহাদাত হোসেন মন্ডল, সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতন : মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, দৈনিক ইনকিলাব, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৯।
. উদ্ধৃত ড. মাহফুজ পারভেজ, ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ : বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহের বিপদ ও করণীয়, সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ২০০৭, পৃ- ৬৮।
. ড. মোহাম্মাদ আবদুর রব, বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন : বিপন্ন সার্বভৌমত্ব, দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ এপ্রিল ২০০১, পৃ-৭।

. শাহাদাত বরণকারী এ ৩ জন হচ্ছেন : শহীদ ল্যান্সনায়েক মো. ওয়াহিদ, শহীদ সিপাহী মো. মাহফুজুর রহমান এবং শহীদ সিপাহী মো. আবদুল কাদের। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল রৌমারীর বড়াইবাড়ি গ্রামে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা রাতের অাঁধারে চোরের মত ঢুকে ডাকাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের নিরপরাধ ও শান্তিকামী নাগরিকদের ওপর। এ ৩ জন সেদিন ভারতীয় হানাদারদের মুকাবিলায় জীবনপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে অকাতরে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বীরত্ব, সাহসিকতা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের কারণে তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দেশবাসীর হৃদয়ে।- দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ এপ্রিল, ২০০১, পৃ.১।
. দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ এপ্রিল ২০০১, পৃ-২।
. সীমান্তে বিএসএফ’র আগ্রাসন, সম্পাদকীয়, দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ জুন ২০০১, পৃ-৬।
. সীমান্ত হত্যা : ৮ মাসে নিহত ৮৫ বাংলাদেশী, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০২, পৃ-১।
. বিএসএফ সীমান্ত অশান্ত করে তোলার পাঁয়তারা করছে, দৈনিক ইনকিলাব রিপোর্ট, দৈনিক ইনকিলাব, ৪ অগাস্ট ২০০৪, পৃ-১২।
. মাহফুজুল হক আনার, দিনাজপুর সীমান্তে বিএসএফ’র প্যারাসুট সেল নিক্ষেপে অগ্নিকান্ড, দৈনিক ইনকিলাব, ৫ অগাস্ট ২০০৪, পৃ-১২।
. বিএসএফ ও ভারতীয় দুর্বৃত্তদের হাতে প্রতি পাঁচদিনে একজন বাংলাদেশী নিহত হচ্ছে, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৪ মার্চ, ২০০৫, পৃ-১৬।
. চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত : ৫ বছরে বিএসএফ ও ঘোষ বাহিনীর হামলায় নিহত ২৪, দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ মার্চ ২০০৫, পৃ-১, এবং পৃ-১৫।
. বিএসএফ প্রতি আড়াইদিনে ১ জন বাংলাদেশী হত্যা করছে, অধিকারের প্রতিবেদন, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২ মার্চ, ২০০৮, পৃ-১।
. গোলাম সরোয়ার সম্রাট, ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে ১৪ মাসে ১৩ জন নিহত, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৩ মার্চ ২০০৮, পৃ-১৬।
. বিএসএফ-’র বিডিআর হত্যা, (সম্পাদকীয়) দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২০ জুলাই ২০০৮, পৃ-৬।
. মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর রিপোর্ট, দৈনিক আমার দেশ, ২১ জুলাই ২০০৮।
. বাংলাদেশী গৃহবধুকে বিএসএফ’র ধর্ষণ, (সম্পাদকীয়), দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৫ এপ্রিল ২০০৯, পৃ-৬।
. সীমান্তে বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা, এ কেমন বন্ধুত্ব? (সম্পাদকীয়) দৈনিক আমার দেশ, ১০ জুন ২০০৯, পৃ-৬।
. আলফাজ আনাম, বেপরোয়া বিএসএফ, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৬ জুলাই ২০০৯, পৃ ১ এবং ১১।
. বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যাকান্ড বেড়েই চলেছে, সংগ্রাম রিপোর্ট, দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ অকটোবর ২০০৯, পৃ-১, ২।
. বিএসএফ’র বাংলাদেশী হত্যা অব্যাহত, (সম্পাদকীয়) দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৮ নভেম্বর ২০০৯, পৃ-৬।
. ফখরে আলম, যশোর সংবাদদাতা, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে বিএসএফ’র হত্যাকান্ড থেমে নেই, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১০ জানুয়ারী ২০১২, পৃ-৮।
. মুহাম্মদ রুহুল আমিন নগরী, সীমান্তে খুনীর ভূমিকায় বিএসএফ, নিষ্ফল বৈঠক এবং আমাদের করণীয়, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ২৩ জুলাই ২০১০, পৃ-৩।
. আলাউদ্দিন আরিফ, সীমান্তে লাশের মিছিল বাড়ছে প্রতিকারে গুলি চালানোর অনুমতি পায় না বিডিআর, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ২০ অকটোবর ২০১০, পৃ-১-২।
. দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ-১-২।
. দৈনিক আমার দেশ, ১৩ মার্চ ২০১১, পৃ-১৬, সরদার এম আনিসুর রহমানের রিপোর্ট।
. ২৮ জানুয়ারী ২০১১ রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘সীমান্ত নিরাপত্তাহীনতা ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মত বিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। - দৈনিক সংগ্রাম, ২৯ জানুয়ারী ২০১১, পৃ-১২।
. দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১১, পৃ-১২।
. বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। বিডিআর-এর পরিবর্তিত নাম।
. দৈনিক আমার দেশ, ৬ মার্চ ২০১১, পৃ-৪.।
. বিউটি আকতার হাসু, ফেলানি : পৈশাচিকতার শিকার, দৈনিক আমার দেশ, ২০ জানুয়ারী, পৃ-৯।
. উদ্ধৃত বিউটি আকতার হাসু, পূর্বোক্ত, পৃ-৯।
. বিউটি আকতার হাসু, পূর্বোক্ত, পৃ-৯।
. দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৬ মার্চ ২০১১, পৃ-২।
. দৈনিক নয়াদিগন্ত রিপোর্ট, ১২ মার্চ ২০১১, পৃ-২।
. উদ্ধৃত ড. মাহফুজ পারভেজ, সীমান্ত সমাচার, দৈনিক আমার দেশ, ২৯ মার্চ ২০১১, পৃ-৭। আরো দেখুন, দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ মার্চ ২০১১, পৃ-১।
. বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাইলে ভারতকে সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। (সম্পাদকীয়), সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ২৯ জুলাই ২০১১, পৃ-৬।
. নাজমুল ইসলাম মকবুল, দেশে চলছে দানবাধিকার, দৈনিক আমার দেশ, ১৬ অগাস্ট ২০১১, পৃ-৬।
. আলাউদ্দিন আরিফ, মহাজোটের তিন বছরে সীমান্তে নিহত ২০০, দৈনিক আমার দেশ, ১৮ ডিসেম্বর ২০১১, পৃ-৪।
. মো. মেফতাউল ইসলাম, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা ও পরাস্ত কূটনীতি, দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৪।
. মুহাম্মাদ রেজাউর রহমান, মৃত্যুর দেয়াল সমাচার, দৈনিক ইনকিলাব, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৯।
. মুহাম্মাদ রেজাউর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ-৯।
. ড. কে. এম. শাহাদাত হোসেন মন্ডল, সীমান্তে বিএসএফ’র নির্যাতন : মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, দৈনিক ইনকিলাব, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৯।
. মানবাধিকার কমিশনের জরিপ রিপোর্ট, দৈনিক সংগ্রাম, ৮ জুলাই ২০১২, পৃ ১, ২।
. বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আমার দেশ, ২ জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা-১, ১৫।
. বিএসএফ’র গুলিতে কলারোয়া ও বেনাপোলে ২ বাংলাদেশী নিহত, হরিপুরে আহত ২, ডেস্ক রিপোর্ট, দৈনিক আমার দেশ, ৩ জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা-১, ৪।
. দৈনিক সংগ্রাম, ৮ জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা-১।
. বিএসএফ’র হাতে জেলা প্রশাসক ও এমপির গ্রেফতার প্রসঙ্গ, সম্পাদকীয়, দৈনিক সংগ্রাম, ৭ জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা-৪।
. বিনাদোষে আটক মিল্টন ফিরেছে, ভুরুঙ্গামারী থেকে এমদাদুল হক মণ্টুর রিপোর্ট, দৈনিক ইনকিলাব, ৮ জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা-১, ১২।

. প্রণব মুখার্জি ভারতের ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থী হিসেবে ভারতের ১৩তম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ২৮ জুন ২০১২ তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। ১৯ জুলাই ২০১২ ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্টিত হয়।
. ড. কে.এম. শাহাদাত হোসেন মন্ডল, পূর্বোক্ত, পৃ-৯।
. সীমান্তে ফের রক্তপাত, সম্পাদকীয়, দৈনিক আমার দেশ, ১৮ ডিসেম্বর ২০১১, পৃ-৬।
. সীমান্তে বিএসএফ’র বর্বরতা, সম্পাদকীয়, দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-৪।
. দৈনিক সমকাল, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-১।
. দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২১ জানুয়ারী ২০১১, পৃ-১৫।
. দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ অগাস্ট ২০১১, পৃ-১।
. হারুন ইবনে শাহাদাত, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত মৃত্যু উপত্যকা, দৈনিক সংগ্রাম, ৬ মে ২০১১, পৃ-১।
. খোলা কাগজ, ২৫ এপ্রিল ২০১১, পৃ-৫।
. দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-১৬।
. বিএসএফ’র নির্যাতনের বিচার চেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সমকাল প্রতিবেদন, দৈনিক সমকাল, ১ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-২।
. ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন, দেখুন, দৈনিক যুগান্তর, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১২, পৃ-১, ১৪।
. ড. মাহফুজ পারভেজ, সীমান্ত সমাচার, দৈনিক আমার দেশ, ২৯ মার্চ ২০১১, পৃ-৭।
. সীমান্তে ফের রক্তপাত- ভারতীয় প্রতিশ্রুতির পুরোটাই প্রহসন! (সম্পাদকীয়), দৈনিক আমার দেশ, ১৮ ডিসেম্বর ২০১১, পৃ-৬।
. মনজুর আহমদ, ফেলানীর লাশ, নতজানু দেশ, দৈনিক আমার দেশ, ৩০ জানুয়ারী ২০১১, পৃ-৬।
. মো. বেলায়েত হোসেন, সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ও নিরীহ মানুষ হত্যা, দৈনিক আমার দেশ, ৩০ জানুয়ারী ২০১১, পৃষ্ঠা-৬।
. ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য খুবই দুঃখজনক যা দেশবাসীর মনে ক্ষোভ ও নিন্দার সৃষ্টি করেছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সীমান্তে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর সাথে অনেক কিছু জড়িত। এগুলো রাষ্ট্রীয় কোন বিচারযোগ্য বিষয় নয়। দুই দেশের পক্ষ থেকেই চোরাকারবারী, মাদক পাচার ও গরু চুরি হচ্ছে। এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। আগেও ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। এটা নিয়ে রাষ্ট্র খুব চিন্তিত নয় বরং সব কর্মকান্ড ফেলে রেখে এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টি নিবন্ধ রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি আরো বলেন, তিলকে তাল করার কোন প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। দেখুন, ড. কে. এম. শাহাদাত হোসেন মন্ডল, পূর্বোক্ত, পৃ-৯।
. মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম. ফজলুর রহমান এনডিসি পিএসসি, ভারতীয় সীমান্ত সন্ত্রাস : কিসের আলামত, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৩ মার্চ ২০০৫, পৃ-৯।