১.

প্রতিরক্ষা একটি জটিল এবং অনালোচিত বা অল্প-আলোচিত ধারণা। সামরিক বিজ্ঞান, রাজনীতি বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, ট্র্যাটেজি, ভূ-রাজনীতি প্রভৃতি বিষয় চ্চর্চা করা হয়।
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার আড়ালে প্রায়-সময়ই প্রতিরক্ষা প্রসঙ্গটি চাপা থাকে; এ প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা বলতে গেলে হয়-ই না। এটা সত্যি যে, প্রতিরক্ষার মূল কৌশল ও পরিকল্পনা সাধারণ্যে আলোচনার বিষয়ও নয়; এতে করে শত্রু পক্ষের কাছে প্রতিরক্ষা প্রস্ত্ততি ও এ সংক্রান্ত পুরো ব্যবস্থাটি পরিস্কার হয়ে যেতে পারে এবং এটা কোনওভাবে কাম্যও নয়।
কিন্তু একটি সাধারণ প্রতিরক্ষা নীতি ও ধারণা মানুষের মধ্যে সুস্পষ্টরূপে থাকা অপরিহার্য। জানা থাকা দরকার, কে বা কারা আমাদের শত্রু, কোন কোন দিক থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যাহত হতে পারে, কিভাবে প্রতিরক্ষা নিরঙ্কুশ রাখা যায়, ইত্যাদি বিষয়াবলী। কারণ যে মানুষ ও তার ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-নিরাপত্তা এবং মানুষের রাষ্ট্রটির জন্য প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার এত আয়োজন, সে রাষ্ট্রের মানুষই যদি স্বীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী না হয়, তাহলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও এর শক্তি বহুলাংশে অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা মানে সেই রাষ্ট্রের মানুষেরও প্রতিরক্ষা আর রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার শক্তি ও সামর্থ্য মানে রাষ্ট্রের মানুষের সম্মিলিত চেতনা এবং এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠা বস্ত্তগত আয়োজন। ফলে প্রতিরক্ষার জন্য বস্ত্তগত-উপাদানগত আয়োজন যেমন জরুরি, তেমনিভাবে নাগরিকদের মধ্যে প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত একীভূত ও পরিচ্ছন্ন চেতনাগত ধারণা থাকাও অপরিহার্য। এই দুই-এর সুসমন্বয় হলেই একটি রাষ্ট্র অভেদ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থার অধিকারী হতে পারে।
পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে ইসলাম জীবনের সকল বিষয়ের মতো প্রতিরক্ষা বিষয়েও সুস্পষ্ট বিধানাবলী এবং ধারণা দিয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, ইসলামের প্রতিরক্ষা ধারণা এতই উন্নততর ও অগ্রসর যে তৎকালীন পৃথিবীর প্রায়-সকল পরাশক্তি ইসলামের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় এবং এরই ভিত্তিতে ইসলাম তার আদর্শগত, রাষ্ট্রীয় এবং মানুষের নিরাপত্তা নিবিঘ্ন রাখতেও সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশের শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ যেহেতু মুসলিম, তাই এ দেশের মানুষের সকল চেতনার মত প্রতিরক্ষা চেতনা ও ধারণাতেও ইসলামের অনুভূতি থাকা অপরিহার্য এবং এভাবেই ইসলামের প্রতিরক্ষা ধারণার মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তার চিন্তাকে উজ্জীবিত করতে পারে এবং এরই ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকেও মজবুত করতে সক্ষম হতে পারে। সোজা কথায়, আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মজবুতির জন্য ইসলাম একটি প্রধান উপাদানস্বরূপ। সন্দেহ নেই, উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠা ধর্মনিরপেক্ষ-প্রতিরক্ষা চেতনা গাছ-নদী-মা-মাটি-প্রকৃতিকে সামনে রেখে একটি আবেগী উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় বটে। কিন্তু ইসলাম প্রতিরক্ষা চেতনার মাধ্যমে এমন একটি যৌক্তিক উপসংহারে মানুষকে পৌঁছাতে পারে বলেই সে তার মানবমন্ডলীকে একটি অপরাজেয় শক্তিতে দেখতে পায়। ইসলামী প্রতিরক্ষা চেতনায় বলীয়ান জানবাজ জনগোষ্ঠী শত্রু পক্ষের কাছে যে ভয়, শ্রদ্ধা ও সম্ভমের শক্তিতে পরিণত হয়, তাতে বিপুল পরাশক্তিও একে একে পরাজিত হয়েছে আর বিজয় চলে এসেছে অবধারিতভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের কাছেই। ইসলামের ইতিহাসে সে সত্য দেদীপ্যমান; ইসলামের গৌরবময় জেহাদসমূহ সে সত্যের সাক্ষ্যবহ। আজকেও তাই, কেবল মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর কাছেই ইসলামের প্রতিরক্ষার ধারণা, এর ব্যবস্থাপনা ও কৌশল গভীর আগ্রহ ও মনোযোগের বিষয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে একটি নবাগত শক্তি হিসাবে এর অপ্রতিরোধ্য বিজয় ও অগ্রগতির বিষয়াবলী এখন পর্যন্ত গবেষণা, অধ্যয়ন ও অনুসরণের মাধ্যমে অনুসৃত হচ্ছে। ফলে প্রতিরক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইসলামের প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং এরই ভিত্তিতে নিজেদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমাদের মতো শত্রু-পরিবেষ্টিত রাষ্ট্র অটল প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হতে পারে।
২.
বিশ্বে যারা শক্তিমান, কোন যুদ্ধের সূচনা করে তারাই। যারা শক্তিহীন, তারা শক্তিমানের কাছে পরাভূত হয়। মানবেতিহাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এটাই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। তবে এর ভিতরেও ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। আর তা ঘটেছে মুসলিমগণের হাতে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে মুসলিমগণই প্রথম প্রতিষ্ঠিত করে যে, শক্তি প্রদর্শন বা নিছক আত্মরক্ষার জন্য নয়, আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্যও যুদ্ধ করতে হয়। এই যে বিশেষায়িত যুদ্ধ, সেটাই হচ্ছে জিহাদ। প্রচলিত যুদ্ধ বলতে যা বোঝা যায়, জিহাদের সঙ্গে তার রয়েছে সুস্পষ্টরূপেই বিস্তর ফারাক। সাধারণ অর্থে যুদ্ধ ও জিহাদ বলতে সশস্ত্র সংগ্রাম বোঝালেও দুটোর মধ্যে প্রচুর প্রভেদ রয়েছে। যুদ্ধের মূলে রয়েছে পররাজ্য গ্রাসের লিপ্সা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অন্য দিকে, জিহাদের উদ্দেশ্য হল দ্বীন ও আত্মরক্ষার তাগিদ এবং অন্যায়ের প্রতিকারের মাধ্যমে ন্যায়, নিরাপত্তা, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। ফলে প্রথাগত অর্থে, মুসলমানরা যুদ্ধ করে না, তারা জিহাদ করে। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণেই প্রচলিত-সাধারণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ইসলামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য। একইভাবে প্রতিরক্ষার ধারণাগত দিক থেকেও গতানুগতিক আর ইসলামী পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে রয়েছে অলঙ্ঘণীয় প্রভেদ। আজকের যুদ্ধবাজ পরাশক্তিসমূহের সামনে ইসলামের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত নীতি ও ধারণা একটি উজ্জ্বল উদাহরণ---যার অনুসরণ তাদেরকে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে শান্তি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাভিত্তিক একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে পারে।
৩.
ন্যায়-যুদ্ধ , যুদ্ধোন্মাদনা , যুদ্ধ -বিগ্রহ বিশ্ব-ইতিহাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট । প্রতিটি যুগেই যুদ্ধ-বিগ্রহ কোনও না কোনও আকারে দুনিয়ার বুকে বিরাজমান ছিল। একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান কালে তথ্য-প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক-প্রযুক্তিগত গবেষণার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে একটি বিশ্ব-বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। ‘বিশ্বায়ন’ নামের এহেন বন্ধনও বিশ্বকে যুদ্ধ মুক্ত করতে পারে নি, বরং একটি যুদ্ধংদেহী পরাশক্তি জোটের লেলিহান বিপদের সম্মুখীন করেছে পৃথিবীর অপরাপর ক্ষুদ্র ও নিরীহ রাষ্ট্রসমূহকে। যুদ্ধের পেছনে খরচ হচ্ছে অপরিসীম অর্থ, যা মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানো হলে বিশ্ব ও মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হত। উদাহরণস্বরূপ, নৈতিক যুদ্ধ বা জিহাদ আর অনৈতিক যুদ্ধ বা আগ্রাসনের একটি পার্থক্যও এখানে লক্ষ্যণীয়। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৫ সালে যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করেছে ৩২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সালে সে ব্যয় বৃুদ্ধ পেয়ে দাঁড়ায় ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে। এরপর থেকে এই খরচের অঙ্ক প্রতি বছর ৫০%ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাই বর্তমানে বিশ্ব ও মানবতার শান্তি ও নিরাপত্তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হতে পারে না যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত, সম্মানজনক, প্রীতিপূর্ণ এবং মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিক হয়। কিন্তু পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, মৈত্রী ও ঐক্যের বাস্তবতাগত প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের শোষণমূলক মনোভাবের মাধ্যমে কতিপয় শক্তিশালী রাষ্ট্র যুদ্ধের ভয়াবহ ঘনঘটা গোটা মানব জাতির উপর সততই সঞ্চরণশীল করে রেখেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অকল্পনীয় ধ্বংসের প্রেক্ষিতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা লীগ অব নেশন্স জন্ম লাভ করে। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যায় ১৯৩৯ সালে জার্মানির ডিকটেটর হের হিটলারের যুদ্ধ ঘোষণার পর। গোটা পৃথিবী দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অগ্নিগর্ভে নিপতিত হলে লীগ অব নেশন্স-এর মৃতদেহের উপর ভর করে যুদ্ধকালীন সময়েই জন্ম নিল আজকের জাতিসংঘ। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তা-ই, যা ছিলো সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা লীগ অব নেশন্স-এর: ‘‘দুনিয়াকে যুদ্ধের ধ্বংস ও রক্তাক্ত হানাহানি থেকে বাঁচানো।’’ কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও কি যুদ্ধের স্থায়ী বিপদ কেটে গেছে? সাম্প্রতিক বিশ্বের রক্তাক্ত ইতিহাস সে কথা বলে না। বরং একটি ক্ষুদ্র, শান্তিপূর্ণ, নিরীহ দেশকে যুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহী না হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি দেশ এমন একটি দেশের উপর হামলা করে বসল যে, আদৌ সে লড়াই করতে ইচ্ছুক নয়। কেউ আমেরিকাকে আক্রমণ করে নি, কিন্তু আমেরিকা বিশ্বের কমপক্ষে পঞ্চাশটি দেশে আক্রমণ চালিয়েছে এবং এখনও একাধিক দেশে একতরফা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে অস্ত্রের ব্যবসা, সম্পদ ও খনিজ লুণ্ঠন, প্রতিপক্ষীয় দর্শন ও আদর্শকে হত্যার সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী মতলব---বর্তমানে যার প্রধানতম শিকার মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহ। ফলে কোনও নিরীহ, শান্তিপূর্ণ, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে, এবং যা বর্তমানে আকছার হচ্ছে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বাধ্য হয়েই ক্ষুদ্র-শান্তিপূর্ণ-নিরীহ রাষ্ট্রটিকে আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র ধারণ করতেই হবে; একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও কৌশল প্রণয়ন করে রাখতেই হবে। আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র ধারণ এবং প্রতিরক্ষা নীতি-ব্যবস্থা-কৌশল প্রণয়ন করে রাখা এমন একটি বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং একই সঙ্গে একটি স্বাভাবিক অধিকার, যার সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রটির নিরাপত্তা ও অস্ত্বিত্ব রক্ষার মৌলিক ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।
৪.
আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র ধারণ , নিজেকে রক্ষার নীতি-ব্যবস্থা-কৌশল প্রণয়ন, একটি বাস্তবসম্মত-প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং একটি স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে নাগরিক-রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অস্ত্বিত্ব রক্ষার মৌলিক ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ কার্যব্যবস্থা, সামগ্রিকভাবে যার নাম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, গ্রহণের উপর ভিত্তি করেই আরবের একজন পিতৃমাতৃহীন যুবক, ইসলামের মহান প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, স্বীয় লক্ষ্যকে সামনে রেখে সমগ্র বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রথম দিকে তাঁকে বিভিন্নমুখী বিপদ-আপদ ও ঝঞ্ঝা-মুসিবত মুকাবিলা করে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নিদের্শে কৌশলগত কারণে স্বদেশ ছেড়ে অন্য স্থানে হিজরত বা স্থানান্তর করতে হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও গতিপথ তিনি কখনওই হারান নি। অবশেষে বিশ্ববাসী এ দৃশ্যও অবলোকন করলো যে, প্রতিটি আগ্রাসী আক্রমণকেই তিনি শুধু পরাজিত করেন নি বরং অল্প দিন পরেই সেই হিজরতকারী ব্যক্তিই বিজয়ীর বেশে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং স্বীয় নীতিমালা বাধাহীনভাবে প্রচার করেছেন; সমগ্র জগতকে শান্তি ও নিরাপত্তার মহামূল্যবান সম্পদে ভরপুর করেছেন।
এসব কীভাবে হলো-
প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাফল্য লাভের আসল কারণ কি ছিল- এই মৌলিক জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে পর্যালোচনা করা হলে ইসলামে প্রতিরক্ষার ধারণাটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে।
গভীরভাবে ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লা আলাইহি ওয়া সাল্লামের সৈন্যদল, অস্ত্রশস্ত্র এবং আর্থিক দিক দুশমনের মুকাবিলায় কখনও কি এক-দশমাংশও ছিল-
এর পরেও কি তিনি হতোদ্যম হয়েছিলেন কিংবা হিম্মত হারিয়েছিলেন-
যদি তা না হয় তবে কেন তা হারান নি-
এখানেই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত ইসলামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও কৌশল নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন এবং গভীরভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি টেকসই, কার্যকরী, মানবতাবাদী প্রতিরক্ষা ধারণা ও ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় দিক-নিদের্শনা দিবালোকের মতো প্রতিটি মুসলিমের সামনেই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছেই প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এবং তথাকথিত যুদ্ধ, আগ্রাসন ও বর্বরতার নামে অকাতরে হত্যা, লুণ্ঠন আর বিপুল অর্থ অপচয়ের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রতিরক্ষা ধারণার মানবিক ও বস্তগত দিকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আজকের যুদ্ধবাজ বিশ্বের জন্য ইসলামী প্রতিরক্ষার ধারণা পরিত্রাণের প্রধান অবলম্বন। একই সঙ্গে বিপুল আগ্রাসী আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধবাজ ও তাদের বিপুল-বিশাল রণসজ্জা ও অর্থনৈতিক প্রস্ত্ততির বিরুদ্ধে হিম্মত না-হারিয়ে বিজয়ী হয়ে নিরাপদ ধাকতে পারার মূলমন্ত্রও আমাদের জন্য নিহিত রয়েছে ইসলামের প্রতিরক্ষা ধারণায়। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, কেবলমাত্র মুসলমানদের সংখ্যা ও শক্তি ইসলামের প্রতিরক্ষাগত বিজয়ের আসল কারণ ছিল না। বদর থেকে খন্দক পর্যন্ত প্রত্যেক যুদ্ধে কাফেররা বেশি সৈন্য ও শক্তির সমাবেশ ঘটায়। সামগ্রিক জনসংখ্যার দিক দিয়েও সে সময় মুসলমানরা আরবে বড় জোর ছিল দশ ভাগের এক ভাগ। মুসলমানের উন্নত মানের অস্ত্রসম্ভারও এ উন্নতির মূল কারণ ছিল না। সব ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র এবং যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামে কাফেরদের পাল্লা ভারী ছিল। অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়েও তাদের সঙ্গে মুসলিম বাহিনীর কোনও তুলনাই ছিল না। কাফেরদের কাছে ছিল সমস্ত আরবের আর্থিক উপায়-উপকরণ। অন্যদিকে মুসলিমগণ অনাহারে মরছিল। কাফেরদের পেছনে ছিল সমগ্র আরবের মুশরিক সমাজ ও আহলি কিতাব গোত্রসমূহ। তদুপরি মুসলিমগণ একটি নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে পুরাতন ব্যবস্থার সকল সমর্থকের সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল। এহেন অবস্থায় যে চেতনা মুসলিমদেরকে ক্রমাগত বিজয়ী করছিল, তাহলো চারিত্রিক ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব। ইসলামের সকল শত্রুদলও এটা অনুভব করতে পেরেছিল। কারণ শত্রুদল দেখতে পাচ্ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর নির্মল, নিষ্কলুষ চরিত্র; এ চরিত্রের পবিত্রতা, দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তা, যা মানুষের দেহ অপেক্ষা হৃদয়কে পূর্বাহ্নেই জয় করে চলেছিল। একই সঙ্গে এটাও দেখা যাচ্ছিল যে, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক নৈতিক পবিত্রতা মুসলিমদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য, শৃঙ্খলা ও সংহতি সৃষ্টি করে দিয়েছিল এবং এর সামনে মুশরিকদের শিথিল, শোষণমূলক ও নিপীড়নভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থাপনা কেবল যুদ্ধাবস্থাই নয়, শান্তির স্বাভাবিক সময়েও পরাজিত হতে বাধ্য হচ্ছিল। এখানেই নিহিত ইসলামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অপরাজেয় শক্তিমত্তা আর শ্রেষ্ঠত্ব।
৫.
প্রথমেই যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তা হলো, ইসলামের আবির্ভারের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের ফলে মুসলিম/ঈমানদারগণ একদিকে হয়ে যান আর কাফের ও সত্যদ্রোহীদল অপর দিকে। মুসলিমদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য কিংবা কোনও প্রকার আলাদা বৈশিষ্ট ছিল না। সবাই এক ও অভিন্ন, ভাই-ভাই এবং সবাই বরাবর---এভাবে সকলেরই লাভ ও ক্ষতি, নিরাপত্তা ও বিপদ একাকার হয়ে যায়। সকলের চিন্তা ও কর্মের নীতি-পদ্ধতিও এক হয়ে যায়। ঐক্যবদ্ধ, সংঘবদ্ধ ও সুসংহত হওয়ার ফলে তাদের ভেতর প্রবল শক্তির সঞ্চার হলো এবং এই সম্মিলিত মানব গোষ্ঠীর সামনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হলো। রক্ত, গোত্র, সম্পর্ক, চিন্তা, কর্মের সকল যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম এবং কাফের-মুশরিক দু‘টি পৃথক জাতিসত্ত্বায় দাঁড়িয়ে গেলো। কাফের-মুশরিকরা মুসলিমদের সত্যপন্থী কথা ও কাজ মানতে পারে না, ন্যায়ানুগ আয়-উন্নতি বরদাস্ত করতে পারে না। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনের এহেন সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি মুকাবেলার জন্য অত্যন্ত দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে হিজরতের প্রথম বছরেই “Nation at War”-এর মূলনীতির বাস্তব শিক্ষা দিতে থাকেন, যে উদ্যোগের হেকমত ও ফলপ্রসূতা অচীরেই সর্বাত্মক বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয়। বস্ত্ততপক্ষে, “Nation at War” এবং জিহাদ একই মূলনীতি থেকে উৎসারিত একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দু‘টি ভিন্ন নাম মাত্র। ফলে প্রতিরক্ষার কাজে মুসলিমগণ যে তিনটি নেয়ামতের প্রয়োগ সশস্ত্র যুদ্ধের আগেই প্রয়োগ করে নিজেদের নিরাপত্তাকে মজবুত এবং শত্রুর উপর নিজেদের প্রাধান্য পূর্বাহ্নেই নিরঙ্কুশ করতে সক্ষম হন, তা-হলো:
ক) কোরআন-সুন্নাহ অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, যা পালৌকিক জীবন ছাড়াও দুনিয়ার সকল সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভের একমাত্র নিয়ামক;
খ) ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য; এবং
গ) “Nation at War” বা জিহাদ, যা শুধু যুদ্ধগত সশস্ত্র অর্থে নয় অন্তরের-মুখের-হাতের-অস্ত্রের ধারাবাহিক ও সময়োপোযোগী ব্যবহার।
৬.
তিনটি নেয়ামতের বরকতে মদীনার ছোট রাষ্ট্রটি সকল দিক থেকে নিরাপদ, পরিপূর্ণ এবং সুসংহত হয়ে গেল। তখন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার পার্শ্ববর্তী গোত্রগলোর দিকে মনোনিবেশ করেন এবং তাদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করেন। একই সাথে মুজাহিদদের সামরিক প্রশিক্ষণও দিতে থাকেন। অর্থাৎ মুসলিম জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়িত করার পর জাতিসত্ত্বাকে মুজাহিদ কওম বানাতে শুরু করেন। আর রাষ্ট্রকে চোখ-কান খোলা একটি জীবন্ত সত্ত্বায় পরিণত করেন, যারা নিজেরা যোগ্য, প্রশিক্ষিত এবং পারিপার্শ্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেবহাল।
উন্নত নীতিমালাশ্রিত রাষ্ট্র কাঠামোয় আরবরা পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে এবং নৈতিক-চরিত্রবান মানুষ থেকে আরও উন্নততর আল্লাহওয়ালা মানুষে পরিণত হতে লাগলেন। এ পর্যায়ে কোরআন তাদের জন্য যে সমরনীতি প্রণয়ন করেছে, মুসলিমগণ সবর্দা গর্বের সঙ্গে তা সভ্য দুনিয়ার কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে প্রদর্শন করতে পারে। কারণ, যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে ঐশী নিদের্শের অধীন, আর তা হলো, সে সমস্ত লোকের যুদ্ধের অনুমতি, যাদের উপর যুলুম-অত্যাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধ নিজেদের হেফাজত এবং যুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ ও অবসানের জন্য করো, যাতে যালিমের যুলুম বৃদ্ধি পেতে না পারে এবং অপর কোন কওমকে যুলুমের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত না করে দিতে পারে। মুসলিমদের জন্য যুদ্ধ করা শুধু আত্মরক্ষা, যুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ করা এবং মজলুম/নির্যাতিতের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সমীচীন বলে অভিহিত করা হয়েছে ঐশী বিধানে।
কিন্তু কী মহানুভবতার সঙ্গে এ-ও নিদের্শ এসেছে যে, অপরাপর ধর্মের উপাসনালয় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমনিভাবে অন্য ধর্মের বুযুর্গ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্যও তাকিদ এসেছে, যাতে মুজাহিদ বাহিনী যুলুম অবসানের জোশে সীমা অতিক্রম না করে। পবিত্র কোরআনের নিদের্শাবলী মূলভাবগুলো লক্ষ্যণীয়:
মালে গনিমত বা যুদ্ধ-লব্ধ মালামাল সম্পর্কেও সতর্কতামূলকভাবে বলা হয়েছে: ‘‘তোমাদের প্রবৃত্তির কোনও অধিকার সেখানে নেই।’’ আরও বলা হয়েছে: ‘‘এর এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের; বাকী অংশ আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য।’’
যুদ্ধে সাহস ও মনোবল অটুট রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে: ‘‘যখন তোমরা যুদ্ধেও ময়দানে কাফেরদের মুকাবিলা করবে তখন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। যে কেউ লড়াইয়ের ময়দানে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তার উপর আল্লাহর গযব পতিত হবে আর তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।’’
যুলুম প্রতিরোধ ও অবসানের লক্ষ্যে লড়াইকে অর্থাৎ জিহাদ করাকে ‘জীবন’ বলা হয়েছে এবং তার গুরুত্ব এভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে: ‘‘হে মু‘মিনগণ, আল্লাহ এবং রসূলের হুকুম মেনে চলো, যে সময় তোমাদের সেই কর্মের দিকে আহবান করা হয় যার ভেতর রয়েছে তোমাদের জীবন।
বিজয় ও সাফল্যের জন্য আল্লাহর মর্জি ও ইচ্ছাকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে: ‘‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাক তবে আল্লাহ পাক তোমাদের ফয়সালার বস্ত্ত প্রদান করবেন এবং তোমাদের পাপরাশি দূরীভূত করবেন আর দেবেন মাফ করে।’’
জিহাদ কতোদিন পর্যন্ত করা হবে, সে সম্পর্কেও নিদের্শ দেওয়া হয়েছে: ‘‘আর তোমরা সেই সময়-সীমা পর্যন্ত লড়তে থাকো যতদিন প্রাধান্য লুপ্ত না হয় শিরক ও ফেৎনা-ফাসাদের এবং সমস্ত দীন একমাত্র আল্লাহর জন্যই হয়ে যায়।’’
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিদের্শনাস্বরূপ সূরা আন-ফালে পরিস্কার আহকাম নাযিল হয়েছে: ‘‘আল্লাহ ও রসূলে নিদের্শ মান্য করো, পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করো না, অন্যথায় তোমরা দূর্বল হয়ে পড়বে আর তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যাবে বিনষ্ট হয়ে।’’
অন্যত্র বলা হয়েছে: ‘‘শত্রুর সঙ্গে লড়াই করবার জন্য যথাসাধ্য সমরাস্ত্র ও সিপাহিসুলভ শক্তি সদা-সর্বদা প্রস্ত্তত রেখো, যেন দুশমনের উপর তোমাদের ভীতিকর প্রভাব কায়েম থাকে।’’
জিহাদের উদ্দেশ্য কেবল যুলুমের অবসান। এক্ষেত্রে সীমাতিক্রম করা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার পয়গামবাহী এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য আপাদমস্তক রহমতস্বরূপ। কোরআনুল কারীমের নিদের্শ: ‘‘যদি দুশমন সন্ধির প্রস্তাব করে তবে তোমরা তাতে সাড়া দেবে এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে। এমনটি যেন না হয় যে, তোমরা শক্তির মোহে সীমা অতিক্রম করো এবং দুশমনের আগ্রহ সত্ত্বেও তোমরা সন্ধি স্থাপনে এগিয়ে না যাও।’’
এগুলো কোরআনুল কারীমের সরাসরি ও প্রকাশ্য হুকুম-আহকাম। বস্তত এটাই হল মূল বুনিয়াদ, যার উপর ভিত্তি করে ইসলাম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিক-নিদের্শ দেয়। এবং এরই ভেতরে জায়েজ ও না-জায়েজ, নিষিদ্ধ ও উত্তমের সীমারেখা পরিষ্কাররূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা ও অনিচ্ছা চ্চর্চার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। খুলে দিয়েছে সকলের জন্য কল্যাণের পথ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রতিরক্ষা নীতি ও বিধানের সঙ্গে মুজাহিদ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে বিশ্বজয়ী অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত করেন। এবং এভাবে এই নীতিমালা অনুসৃত প্রশিক্ষণই মুষ্টিমেয় মরুচারী মুসলিমকে এমনই শক্তি, একতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে যে, সমকালীন অপরাপর শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহর রাস্তায় নিবেদিতপ্রাণ একেকজন মুজাহিদ আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অগণিত দুশমনের বিরুদ্ধে অধিকতর কঠিন ও বিজয়ী হয়ে দাড়ান।
যুদ্ধরত বাহিনীর জন্য সমরোপকরণ ও মারণাস্ত্র নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরী। এসব ছাড়া যুদ্ধের কল্পনা খুবই হাস্যকর। কিন্তু উত্তম কর্ম এবং চারিত্রিক সৌন্দর্য ব্যতিত বিপুল সমরোপকরণের অধিকারও ফলপ্রসূ হয় না। যুদ্ধের এই নিয়ম-নীতি, বিশেষত আল্লাহর সাহায্যের খোশ-খবর এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যোগ্য কমান্ড, সত্যের পক্ষে উন্নত-মস্তক অবস্থান ইসলামের প্রতিরক্ষা ধারণার মূল ভিত্তি এবং এভাবেই ইসলাম নিজেকে নিরাপদ রেখেছে, দৃঢ় প্রতিরোধ-ব্যবস্থার অধীনস্থ করেছে আর বাতিলের পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। অতএব দুনিয়া এর বিস্ময়কর প্রদর্শনী দেখলো এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই দেখে নি বরং মুসলিমরা তাদের আসল ও মৌলিকত্বের দিকে যখনই প্রত্যাবর্তন করেছে এবং কিতাব ও সুন্নাহকে যখনই কর্ম-নির্দেশিকা বানিয়েছে, ফলাফল তখন এমনই বিস্ময়করভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের পক্ষে গিয়েছে।

৭.
ইসলামের প্রতিরক্ষা ধারণায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিরক্ষাগত ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও কৌশল, তাঁর আওতায় পরিচালিত সমস্ত যুদ্ধ ও অভিযান ইত্যাদি সব কিছুই কেবলমাত্র মুসলিমদের জন্যই নয়, প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান, সমরশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠক-গবেষক-বিশেষজ্ঞদের জন্য কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিশেষ বৈশিষ্টের কারণে বর্তমানেও অনুসরণীয় :
• প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হবে সাদাসিধে কিন্তু পরিপূর্ণ। সাদাসিধে হওয়ার অর্থ হলো, এর ভেতর এমন সুযোগ রাখতে হবে যে, যুদ্ধের পরিবর্তিত অবস্থা অনুযায়ী যেন খুব সহজে উপযুক্ত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যায়। কারণ কোনও বিশেষজ্ঞই আগাম ও সঠিকভাবে বলতে পারে না যে, যুদ্ধের মধ্যে কথন কিরূপ অবস্থা হবে। ফলে নানা সম্ভাবনা ও আশঙ্কাকে সামনে রেখে এমন পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে সেটাকে প্রয়োজনের দাবি অনুযায়ী বা প্রতিপক্ষের গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী অদল-বদল করা যায়। স্থবির ও অনড় যুদ্ধনীতির বদলে চলিষ্ণু ও পরিবর্তনযোগ্য যুদ্ধনীতি শ্রেয়।
• প্রতিরক্ষার মূল নীতি অল্প, অপরিবর্তনীয় এবং পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে অলঙ্ঘনীয়ভাবে প্রণীত। তবে সেটা বাস্তবায়নের উপায়-উপকরণগত ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে নানা পরিবর্তন হয় এবং এহেন পরিবর্তন হতেই থাকবে। সে কারণে প্রতিরক্ষাগত পরিস্থিতির নানা পরিবর্তন ও গতিপ্রবাহ নিরবিচ্ছিন্নভাবে অনুধাবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণের কাজে স্থায়ী, প্রশিক্ষিত, বিশেষজ্ঞ জনশক্তির মাধ্যমে মানুষকে প্রতিরক্ষার গতি-প্রকৃতিগত আপ-টু-ডেট ধারণা প্রদান ও সচেতন-সপ্রস্ত্তত রাখার কাজটি অব্যাহত রাখতে হবে।
• যুদ্ধের পক্ষ কোনও রাষ্ট্র বা একক শক্তি হতে পারে কিংবা একের অধিক রাষ্ট্র বা শক্তি মিলিত ফ্রন্ট বানিয়েও আসতে পারে। অতএব সব ধরনের বিবেচনা সামনে রাখা খুবই জরুরি।
• প্রতিরক্ষার বিষয়টি কেবল যুদ্ধের সময় নয়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই তৈরি করে রাখা জরুরি। এবং সেটা যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত হওয়া দরকার।
• প্রতিরক্ষার মূল বিষয় গোপন থাকা প্রয়োজন।
• প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াবলী মেধাগত দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
• প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রতিশোধমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে সর্ব প্রকারের ক্রুটিমুক্ত হতে হবে।
• প্রতিপক্ষের কৌশল সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব পূর্ব-জ্ঞান লাভ করা দরকার, যাতে তাদের চেয়ে অগ্রসর পদক্ষেপ গ্রহণ করে শত্রুপক্ষকে স্তম্ভিত ও অসহায় করে সহজ বিজয় অর্জন করা যায়। এজন্য গুপ্ত সংবাদদাতা, গুপ্তচর, কমান্ডো ও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।
• যোদ্ধা ও নাগরিকদের মনে ইচ্ছার দৃঢ়তা, নির্ভিকতা, সাহসিকতা, এবং নেতৃত্ব মান্য করার গুণাবলী সম্পন্ন করতে হবে। শত্রুকে ছোট জ্ঞান না-করার পাশাপাশি নিজস্ব আস্থায় বলীয়ান হতে হবে। কোনওরূপ হীনমন্যতাকে স্থান দেওয়া যাবে না।
• শারীরিক ও উপাদানগত প্রাধান্যের জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
• বিজয় কিংবা আত্মোৎসর্গের মনোভাব সম্পন্ন হতে হবে তুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও সাফল্যের বিষয়টিকে অত্যান্ত প্রাধান্যের সঙ্গে সামনে এগিয়ে দিয়ে---এমন চেতনাই সকল চেতনার সামনে ইসলামকে বিজয়ী ও অপরাজেয় করেছে।
• প্রতিরক্ষার চূড়ান্ত সময়ে সিপাহি যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করেন আর জাতির প্রতিটি সদস্যই কোনও না-কোনও ক্ষেত্রে লড়ে যান। কেউ অস্ত্র চালান, কেউ কলম চালান, কেউ অর্থ-বিত্ত-মেহনত দিয়ে সহযোগিতা করেন। এভাইে সকলে নানা ক্ষেত্র থেকে ফরয আদায় করেন। এক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সকলে সম্মিলিত অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
• সকল পূর্ণ বয়স্ক নর-নারীসহ নাগরিক সমাজের সকলের মধ্যে ইসলামের প্রতিরক্ষাগত প্রাথমিক ধারণা, সে ধারণার আলোকে স্ব স্ব শরিয়তী দায়িত্ব এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিরক্ষা কৌশল, যুদ্ধ নীতির পরিচ্ছন্ন বিবরণ ও জ্ঞান সঞ্চার করা একান্ত অপরিহার্য।
• এই বাস্তবতা ও বিশ্বাসকে স্মরণে রাখা দরকার যে, যদি কোনও জাতি প্রতিরক্ষা ধারণা, ব্যবস্থাপনা ও কৌশল না-বোঝে; সমরাস্ত্র, সমর শাস্ত্র, আন্তর্জাতি সম্পর্ক, বিশ্ব পরিস্থিতি, শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণের জ্ঞান অর্জন না-করে; ঈমান, দেশপ্রেম, ঐক্য ও শৃঙ্খলার মধ্যে না-থাকে; যুলুম-নিপীড়নের মূলোৎপাটনের কাজে উৎসর্গীকৃত না-হয়; জীবন ও মৃত্যুকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করতে না-পারে---তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে তারা কখনও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে না; শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে না বরং পদানত হয়।
• ইসলাম কখনওই পদানত হওয়ার শিক্ষা দেয় না, শিক্ষা দেয় কল্যাণ, মানবতা, শোষণমুক্ত মানব-সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে যে-কোনও শত্রুপক্ষ ও বাধাকে পরাজিত করে বিজয়ী হতে। প্রতিরক্ষার জ্ঞানগত ধারণা ও প্রস্ত্ততি এমন বিজয়ের পথকে দেশ-কালভেদে বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের সামনে সহজ ও নিশ্চিত করে।
• ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি স্বাধীন ও সাবলম্বী মুসলিমের এ কথা মনে রাখা জরুরি যে নিজের দেশ ও নিজেকে রক্ষার জন্য, মযলুমের সাহায্যের জন্য, পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা-সৃষ্টিকারী তাগুতকে পরাজিত করে শান্তি-নিরাপত্তা-কল্যাণ প্রতিষ্ঠার্থে সামগ্রিক প্রতিরক্ষায় তার একটি নির্ধারিত ভূমিকা রয়েছে। অতএব এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ ও প্রস্ত্ততিকে জীবনের একটি স্বাভাবিক অঙ্গ হিসাবে পালন করতে হবে এবং প্রতিরক্ষার নীতি-কৌশল সম্পর্কে ইসলামের বিধানাবলী সম্পর্কে অভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিমুক্ত স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে।
৮.
ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করে সকল ঐতিহাসিকই বলেছেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিমগণ পার্শ্ববর্তী উপজাতি ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেসব যুদ্ধ-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, সেগুলো ঘটেছিলো পৌত্তলিকদের আগ্রাসী ও নিষ্ঠুর শত্রুতার কারণে আর এজন্যই দরকার হয়েছিল ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার। প্রথম আক্রমণ আসলো কাফিরদের পক্ষ থেকে এবং বদরের প্রান্তরে তারা পরাজিত হলো। পরাজিত ইসলামবিরোধী অপশক্তি দেখতে পেলো যে, বদর থেকে খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌঁছুতেই মুসলিম শক্তির উত্থান ব্যাপকতর হতে শুরু করেছে। ফলে মুশরিক, কাফের, ইহুদি, মুনাফিক ও দোমনা-সংশয়ী নির্বিশেষে সকল ইসলাম-বিরোধী পক্ষ এ কথা অনুভব করতে থাকে যে, এ নব উত্থিত শক্তিটিকে (ইসলাম) শুধুমাত্র অস্ত্র ও সমর শক্তির মাধ্যমে পরাস্ত করা যেতে পারে না। খন্দকের যুদ্ধে প্রতিপক্ষ একজোট হয়ে দশ হাজার সেনা নিয়ে মদীনা আক্রমণ করেছিল। কিন্তু মদীনার উপকণ্ঠে এক মাস ধরে মাথা কুটবার পর শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনোরথ হয়ে পিছু ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে যুদ্ধাঙ্গনে মুসলিম শক্তি এবং মুসলিমবিরোধী অপশক্তির মনোভাবটি স্পষ্ট হয়।
বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলিমদের যুদ্ধের বিবরণেও আত্মরক্ষা, আগ্রাসী-যুলুমবাজদের প্রতিরোধ এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে চলে আসতে দেখা যায়। ইসলামের ইতিহাসে বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম উত্থান মূতার যুদ্ধ , আর তাবুকের অভিযান করা হয়েছিলো গ্রীকদের হাতে মুসলিম দূতের হত্যার কারণে; ইসলামের সীমান্তকে নিরাপদ করার জন্য। মুসলিমগণ যদি প্রাচ্যের খ্রিস্টানদের এই নরহত্যার জন্য শাস্তি না দিত, তাহলে যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইসলামের সুমহান মর্যাদা এতোটা সমুজ্জল হতে পারতো না; হেরাক্লিয়াসের আগ্রাসী-আধিপত্যবাদী শক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব হতো না। ইতিহাসের গৌরবময় উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এটাই যে, শত্রু ও আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে এত অভূতপূর্ব সাফল্যের পর এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর দুর্বলতার সকল তথ্য-সংবাদ জেনে ফেলার পরও মুসলিম বাহিনী সংযত এবং ইসলামের নীতিমালার অধীনে থাকতে সমর্থ হয়েছে। বরং যুদ্ধই মুসলিমদের উপর এসে পড়েছে। যুদ্ধ কীভাবে মুসলিমদের উপর এসে পড়েছে, সেটা মদীনায় কাফের-মুশরিক আক্রমণকারীদের তৎপরতার মাধ্যমে প্রমাণযোগ্য।
একইভাবে গ্রীক সাম্রাজ্যের ব্যাপকতা মুসলিমদেরকে খ্রিস্ট জগতের অধিকাংশের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে টেনে আনে। কারণ, বাইযান্টাইন সম্রাটের ক্ষীয়মান কর্তৃত্বের অধীনে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মর্যাদা এমন জগা-খিচুড়ি মার্কা ছিলো যে, তাদের কারও সাথে সন্ধি-চুক্তি করে বিবাদ নিষ্পত্তি করা মুসলিম নেতৃবৃন্দের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একজনকে পরাভূত করে চুক্তির মধ্যে আনতে-না-আনতেই আরেকজন শত্রুতামূলক একটা কিছু করে বসে, আর মুসলিমগণ এর শাস্তিবিধান করতে বাধ্য হয়। ফলে মুসলিমগণ প্রায় সমগ্র খ্রিস্ট জগতের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় নিপতিত হয়।
অর্থাৎ আত্মরক্ষা আর রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার বাইরে আক্রমণকারী হিসাবে কখনওই মুসলিম শক্তিকে দেখতে পাওয়া যায় নি এজন্যই যে, ধর্মের বিধানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবেই প্রতিরক্ষার বিধান ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতি-নিয়মকেও লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ ও অন্তর্ভূক্ত করা রয়েছে ইসলামে। কাজেই মুসলিমগণ তাদের শক্তি ও ক্ষমতার মধ্যাহ্নকালেও শত্রুদেরকে সব সময়ই বলতে পেরেছে:
‘‘আমাদের প্রতি শত্রুতা বন্ধ করো, আর আমাদের মিত্র হয়ে যাও, আমরা তোমাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো; অথবা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে কর দাও, আমরা তোমাদের সকল অধিকার নিশ্চিত করবো আর রক্ষা করবো; অথবা আমাদের ধর্ম গ্রহণ করো, তাহলে আমাদের যা আছে তার সমস্ত সুযোগ-সুবিধাই তোমরা ভোগ করতে পারবে।’’
মুসলিমদের যুদ্ধ আইনের ভিত্তি আল্লাহর যেসব প্রধান নিদের্শাবলী এবং যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়েন অপরাজেয় মানুষগুলোকে এবং এর মধ্যেকার জ্ঞানবত্তা ও মানবতাবোধ ইসলামী ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে, সেই ঐশী নিদের্শনা অলঙ্ঘণীয়। আর এ সকলই আজ-কাল-আগামীর প্রতিরক্ষাগত চিন্তা ও বিবেচনার মৌলিকভিত্তি, যাকে কেন্দ্র করে এবং মূলাদর্শ ধরে বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রতিরক্ষা নীতি ও কৌশল প্রণয়নের দাবি রাখে:
‘‘আর তোমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে, আল্লাহর ধর্মের জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; কিন্তু তাদেরকে প্রথমে আক্রমণ করে বাড়াবাড়ি করতে যেও না, কারণ যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন না। আর যেখানেই আত্রমণকারীকে পাও সেখানেই তাদেরকে হত্যা করো, আর যেখান থেকে তোমাদেরকে তারা তাড়িয়ে দিয়েছিলো সেখান থেকে তোমরাও তাদেরকে বের করে দাও, কারণ নির্যাতন হত্যার চেয়েও খারাপ; আর কাবা-প্রাঙ্গনে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো না, কিন্তু তারা যদি আক্রমণ করে তবে তাদেরকে হত্যা করো; ওই হচ্ছে অবিশ্বাসীদের উচিত পুরস্কার। ... আর তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো যাবৎ তা নির্যাতনে পর্যবসিত না হয়, কারণ ধর্মটা তো কেবল আল্লাহরই ব্যাপার; কিন্তু তারা যদি ক্ষান্ত হয়, তবে আর যেন শত্রুতা করা না-হয় শুধু উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ছাড়া।’’
মুসলিমগণ যে পারস্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ঘোরায়, তা কেবল অবস্থার গতিকে বাধ্য হয়েই। মুনযির বংশ নামে একটি আধা-আরব পরিবার পারসিক রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় হিরায় রাজত্ব করছিল। রাজনৈতিক দিক দিয়ে শত্রু ভাবাপন্ন হলেও তারা ধর্ম আর সম-স্বার্থের বন্ধনে বাইযান্টাইনদের সাথে মিত্র-ভাবাপন্ন ছিল। গ্রীকদের সাথে মুসলিমদের প্রথম সংঘর্ষের ফলেই মুনযির শাসনাধীন প্রজাদের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা উচ্ছৃঙ্খলার অঙ্গ হিসাবে পার্শ্ববর্তী উপজাতিগুলোর উপর লুটতরাজমূলক হামলা শুরু করে, আর ক্রমান্বয়ে মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একক শাসনকর্তার পরিচালনাধীন একটি শক্তিশালী সরকার, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর তাঁরই নীতি-আদর্শ-প্রশিক্ষণে দীপ্ত হয়ে নানা বিদ্রোহ দমনের আরও সুসংবদ্ধ একটি সরকার, একটি ভেঙ্গে-পড়ো-পড়ো সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ক্ষুদ্র রাজ্যের হাতে অন্যায়ভাবে অপমান নীরবে সহ্য করতে পারে নি।
হিরা বিজয়ের ফলে মুসলিম বাহিনী এসে পড়ে পারস্য সাম্রাজ্যের অঙ্গনে। পারস্য তখন দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নৃশংস হত্যাকান্ড আর নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের পর একজন তেজোদীপ্ত শাসনকর্তারূপে পেয়েছিল ইয়াযদজর্দকে। এই সম্রাটের নিদের্শে পারসিক সেনাপতি মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশ্বস্ত সাথী হয়রত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন মদীনার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তিনি ইসলামের প্রতিরক্ষা বিধানের একনিষ্ঠ অনুসরণের মাধ্যমে পারসিকদের যুদ্ধে আহবানের সশস্ত্র জবাব দেওয়ার আগে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ইয়াযদজর্দের কাছে দূত মারফত ‘সাধারণ শর্তাবলী’ প্রেরণ করেন।
এই শর্তাবলী ছিল ইসলাম কবুল করা, যার অর্থ ছিল যে-সমস্ত রাজনৈতিক অনাচারের ফলে চরম নীচ স্তরে নেমে যাওয়া সাসানীয় সাম্রাজ্যিক ব্যবস্থার সংস্কার, যে-সমস্ত খাজনার ভারে জাতির জীবন শুকিয়ে যাচ্ছিল তার উচ্ছেদ, ইসলামের সাম্য ও ন্যায়-নীতির অনুসারে বিচার-ব্যবস্থা প্রবর্তন, যার ফলে আইনের চোখে সমস্ত মানুষ পদ ও মর্যাদা নির্বিশেষে সমান বলে গণ্য হবে। বিকল্প শর্ত ছিল বশ্যতা স্বীকারমূলক কর প্রদান, যার পরিবর্তে তারা নিরাপত্তা লাভ করবে।
এই শর্তাবলী পারস্য সম্রাট প্রত্যাখ্যান করেন---ফলে আসে কাদিসিয়ার দিন।
বিজয়ের পর খলীফা কঠোর নিদের্শ দান করেন যে মুসলিমগণ যেন কোনও ক্রমে তাইগ্রিস নদী পার হয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর না হয় এবং ঐ নদী চিরতরে পারসিক আর সারাসেনিক সাম্রাজ্যের সীমা নিদের্শ করবে। মেসোপটেমিয়ায় পরাজিত হয়ে পারসিকদের গাত্রদাহ শুরু হয় এবং তারা আরও বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা অব্যাহত রাখে। ফলে মুসলিমদের প্রচন্ড প্রতিরোধমূলক-আক্রমণে পারস্য-রাজের ক্ষমতা অনুদ্ধরণীয়ভাব বিচূর্ণ হয়ে যায়। যে-সমস্ত সম্ভান্ত ব্যক্তির আর পুরোহিত শ্রেণীর নেতাদের স্বার্থ ছিল বিশৃঙ্খলা আর অত্যাচারের রাজত্ব বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে, তাদের অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সমগ্র সাধারণ পারসিকরা মুসলিমদের তাদের উদ্ধারকর্তা হিসাবে অভ্যর্থনা জানায়। তাইগ্রিস থেকে আলবুর্জ, আর আলবুর্জ থেকে ট্রান্সঅক্সিনিয়া পর্যন্ত বিপুল ভূখন্ড আর এর জনগণ মুসলিমদের বিজয়ে প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতা অমৃত পান করে।
৯.
প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ নীতির পর্যালোচনায় এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, ইসলাম তরবারিতে হাত দিয়েছে আত্মরক্ষার জন্য, তরবারি হাতে ধরে রেখেছে আত্মরক্ষার জন্য, আর তা করবেও চিরকাল----এটা ইসলামের বিধান। ইসলাম কখনও কারও নৈতিক বিশ্বাস বা অধিকারের উপর আগাম হস্তক্ষেপ করে নি, কখনও ধর্মীয় নির্যাতন করে নি, কখনও যাজকীয় তদন্ত-সভা স্থাপন করে নি---যেমনটি করেছে গোড়া খ্রিস্টরা। মতভেদকে শ্বাসরোধ করে মারার জন্য, কিংবা মানুষের বিবেককে গলা টিপে হত্যার জন্য, অথবা বিরোধী ধর্মমত নিপাতের জন্য ইসলাম কখনও ‘র‌্যাক’ বা ‘স্টেক’ আবিস্তার করে নি---ব্যবহার করা তো দূরের কথা।
ইতিহামের উপযুক্ত জ্ঞান আছে, এমন কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, খ্রিস্টান গির্জা যখন নিজেদেরকে পরম অভ্রান্ত বলে প্রচার করছে তখনও তারা নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত করেছে মানব জাতির মধ্যে সৃষ্ট যে-কোনও প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি মাত্রায়। যেসব নর-নারী গির্জার অধীনতা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে, এমনকি অন্য ধর্মমতে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে, তাদের ভাগ্যও কোনও অংশে কম নিষ্ঠুর ছিল না। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এমন অনেককে পুড়িয়ে বা ফাঁসি দিয়ে মারা হয়, কারণ তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একজন খারাপ লোক বলে মনে করতে পারেন নি। এমনকি, ১৫২১ সালে খ্রিস্ট জগতের দেশগুলোতে চরম ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রের স্বার্থে ভিন্নমত প্রকাশকদের মৃত্যুদন্ড দানের ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পুড়িয়ে মারা আর ফাঁসি দিয়ে মারা, জিহবা টেনে ছেঁড়া আর জিহবা মোচড়ানো ইত্যাদি ছিল গোঁড়া যাজকতন্ত্রী-খ্রিস্টধর্মমত গ্রহণ করতে অস্বীকারকারীদের প্রতি প্রদত্ত সাধারণ শাস্তিও নমুনা। গণতন্ত্রের তথাকথিত সূতিকাগার ইংল্যান্ড প্রোটেস্টান্ট হয়ে যাওয়ার পর প্রেসবাইটারিয়ানপন্থীদের পরপর বহু বছর বন্দি করে রাখে; তাদের দেহ পুড়িয়ে ভস্মিভূত করে দেয়; অঙ্গহানি ঘটায়; চামড়া খসানো হয়; এবং ‘পিলোরি'তে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। স্কটল্যান্ডে তাদেরকে ধরার জন্য চোর-ডাকাতের মতো পাহাড়ে-পর্বতে তাড়িয়ে নিয়ে নিভৃত্যে গিয়ে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তাদের কান গোড়া থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে; লোহা পুড়িয়ে গায়ে দগদগে দাগ দেওয়া হয়েছে; আঙুলচাপা যন্ত্র দিয়ে আঙুল টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে; পিটিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে গুড়া করা হয়েছে। মেয়েলোককে খোলা রাস্তায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাবুক মারা হয়েছে। আনাব্যাপটিস্ট আর অ্যারিয়ানদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আবার অ-খ্রিস্টানদের [ইহুদি ও মুসলিম] বেলায় ক্যাথলিক-প্রোপেস্ট্যান্ট, গোঁড়া আর অ-গোঁড়া, সমগ্র খ্রিস্ট জগত পূর্ণ ঐক্যমতের সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়ে পরম উল্লাসে সম্মিলিতভাবে নির্যাতন করেছে। ইংল্যান্ডে ইহুদিদেরকে পশুর মতো পেটাতে-পেটাতে নিঃস্বভাবে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্পেনে মুসলিমদেরকে মসজিদের ভেতরেই নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অশ্বেতাঙ্গদের বেলায় কি নির্মম আচরণ করা হয়েছে তা উল্লেখ করার মধ্যেও আতঙ্ক জেগে উঠে।
মানুষের আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে অত্যান্ত অমানবিকভাবে পায়ে পিষে ফেলার এই ভয়ঙ্কার-নিবর্তনমূলক ইতিহাস থেকে তুলনামূলক বিবেচনায় ইসলামের দিকে চোখ ফেরানো হলো সুস্পষ্ট পার্থক্যটি কারও পক্ষে অনুধাবন করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না। গোঁাড়াপন্থী খ্রিস্টধর্ম যখন ইহুদি আর নেস্টোরিয়ানদেরকে সমান হিংস্রতা সহকারে নির্যাতন করে---তাদের বিমূর্ত ঈশ্বরকে যারা ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, ইহুদিরা তাদের বংশধর বলে, আর নেস্টোরিয়ানরা তাঁর মাকে উপাসনা করে না বলে---ইসলাম তখন উভয়কেই আশ্রয় আর নিরাপত্তা দান করে। খ্রিস্টান ইউরোপ যখন ডাইনি ও বিচ্যুতমতাবলম্বীদেরকে পোড়ায় আর ইহুদিদেরকে ও খ্রিস্ট-ধর্মে-অবিশ্বাসীদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করে, মুসলিম শাসনকর্তারা তখন তাদের তরবারিকে অধীনস্থ অমুসলিম প্রজাদের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার্থে ব্যবহার করে। সুবিবেচনা ও সহনশীলতার চরম পরাকাষ্ঠার এমন নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। যে খ্রিস্টান জগতে ধর্মের পার্থক্য যুদ্ধ ও হত্যার কারণ , ইসলামে সেটা চরম উদারতা, সহনশীলতার বিষয়। খলীফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন পরাজিত জেরুসালেমের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন, তখন তিনি নগরীতে প্রবেশ করেন প্যাট্রিয়ার্ক সফ্রেনিয়াসের পাশাপাশি অশ্বারোহণ করে, নগরীর প্রাচীন নিদর্শনাদি সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে করতে। নামাযের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন চার্চ অব রিসারেকসন-এ, কিন্তু সেখানে তিনি নামায আদায় করতে অস্বীকার করেন, নামায আদায় করেন তিনি চার্চ অব কনস্ট্যান্টান-এর সিঁড়ির উপর। তিনি প্যাট্রিয়ার্ককে বলেন: ‘‘আমি যদি কোনও গির্জায় নামায আদায় করি তাহলে ভবিষ্যতে মুসলিমগণ আমার উদাহরণ অনুকরণ করে সন্ধিভঙ্গ করতে পারে।’ অর্থাৎ গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করার মতো ব্যাপার ঘটে যেতে পারে---তা-ই পরধর্মের প্রতি এমন সহনশীলতা ও সতর্কতা। অথচ খ্রিস্ট-ক্রসেডকারীরা যখন জেরুসালেম জয় করে তখন ছোট শিশুদের মাথা দেয়ালে আছড়ে ঘিলু বের করে দেয়। কচি কিশোরদের নগরীর উঁচু দেয়াল থেকে নিচে নিক্ষেপ করে অকাতরে হত্যা করে। পরাজিত মানুষদেরকে আগুনে সিদ্ধ করে মারে। সোনা গিলে পেটে রেখেছে কি-না, সেটা দেখার জন্য জীবিত মহিলাদের পেট চিরে ফেলে। ইহুদিদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে তাদের উপাসনালয় সিনাগগে ঢুকিয়ে হত্যা করে। প্রায় সত্তর হাজার লোক তথাকথিত বিজয়ী দলের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এমনকি মান্যবর পোপের দূতকেও দেখা যায় এ বিজয়-পরবর্তী হত্যা-লুণ্ঠনে বীরদর্পে অংশ গ্রহণ করতে। আর গাজি সালাহউদ্দিন যখন নগরী পুনরুদ্ধার করেন, তখন তিনি সকল খ্রিস্টানকে ছেড়ে দেন; তাদেরকে অর্থ ও খাদ্য দান করেন; তাদের জন্য পাহাড়ার ব্যবস্থা করেন।
ইসলাম স্বীয় প্রতিরক্ষা ও আত্মরক্ষার জন্য ‘তরবারি ধারণ করে’; মানবতাকে মুক্তির জন্য মানবতার স্বার্থে যুদ্ধে যোগ দেয়; যুলুম-নিপীড়ন উচ্ছেদের জন্য যালেমের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার উচ্চারণ করে---এটাই প্রতিরক্ষা প্রসঙ্গে ইসলামের মূল ধারণা। অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদ অস্ত্র ধারণ করে চিন্তার স্বাধীনতা আর বিশ্বাসের মুক্তিকে শ্বাসরোধ করে মারার জন্য; মানবতাকে রক্তাক্ত করার জন্য। অতীতে এ কথা যেমন সত্য, বর্তমানে সেটা আরও সত্যরূপে প্রতিভাত। বিশ্ব ইতিহাসের পাঠকদের কাছে এতটুকু ইঙ্গিতই যথেষ্ট, কারণ তারা পুরো রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন।
১০.
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের মাত্র দু‘ বছর পরে ৬২৪ সালে সংঘটিত ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ‘বদর’ থেকে শুরু করে ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয় পর্যন্ত ছোট-বড় শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক যুদ্ধ পর্যালোচনা করলে আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাই যে, সেগুলোতে তদানীন্তন আমলের বৃহৎ শক্তির প্রায় সবগুলো জাতিই সম্পৃক্ত ছিল। যুদ্ধের এক পক্ষে ছিল নবাগত মুসলিম শক্তি আর অন্য দিকে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য শক্তি। মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে ছিল তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী নানা জনগোষ্ঠী---আরব, বারবার, তুর্কী, ইরানি, হাবশি, কুর্দি, আফগানসহ অনেকেই। বিপক্ষে ছিল রোমান, পারসিক, ভিসিগোথ, পারশিক, ক্রুসেডার, মোঙ্গল ও রাজপুতেরা। যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মুসলিম পক্ষ বেশী যোগ্যতার পরিচয় দিতে পেরেছে, প্রমাণ করতে পেরেছে তাদের নৈতিক, আদর্শিক ও উপকরণগত উপযুক্ততা এবং বিজয়ও তারাই ছিনিয়ে এনেছে। প্রতিটি যুদ্ধের জন্যই এ কথা সমানভাবে সত্য।
প্রাথমিক যুগের মুসলিমরা ছিলেন মরুভূমির সন্তান। ইসলাম তাদের মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা আর সাম্যের সহজাত অনুভূতি জাগ্রত করে। এবং সেই সহজাত প্রবণতাকে তীব্রতর ও বেগবান করে ঈমান, একতা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের সঙ্গে জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ-এর অনুপম চেতনা-শক্তি।
পক্ষান্তরে মুসলিমগণ যে সমস্ত শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই দু‘টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। একদিকে ছিল সুবিধাভোগীর দল আর অন্যদিকে নিপীড়িত-নির্যাতিতগণ। সুবিধাভোগীদের দলে ছিল সামন্ত প্রভু এবং গির্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে ভূমিদাসগণ। ধর্ম ও নৈতিকতার সাম্য ও মানবিকতায় ঐক্যবদ্ধ মুসলিমগণ যখন বিজয়ীর বেশে অবর্তীণ হন তখন নির্যাতিত ও বঞ্চিতরা তাদেরকে গ্রহণ করে ত্রাণকর্তারূপে। মুসলিমদের বিজয়ের মধ্য দিয়েই তাদের মুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বিরোধী পক্ষের এই অনৈক্যকে মুসলিম শক্তি খুব ভালোভাবে কাজে লাগায় কারণ তাদের যুদ্ধের অন্যতম মূল কথাই হলো: ‘শোষণ/যুলুমের অবসান’।
এই আদর্শিক অগ্রসরতার জন্যই মুসলিম শক্তি সামরিক দিক দিয়ে এবং মনোবল আর সরঞ্জামের প্রাগ্রসরতার বিবেচনায় শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে এবং বিভক্ত-ভঙ্গুর শত্রু পক্ষকে সহজেই বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে যখন মুসলিম বাহিনী যে এলাকাতে গেছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী মুক্তির দিশারীরূপে তাদেরকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। তারা প্রমাণ পেয়েছিল যে, মুসলিমগণই তাদেরকে সামন্ত প্রভু এবং যাজক সম্প্রদায়ের শোষণ ও উৎপীড়ন, অজ্ঞতা এবং অসহিষ্ণুতার কঠোর শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি দিতে সক্ষম।
বস্ত্ততপক্ষে শত্রু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের উপর আগাম নিয়ন্ত্রণ ও আস্থা অর্জনের বিষয়টি মুসলিমদের বিজয় লাভের ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ অবস্থা যতদিন বজায় ছিল, মুসলিম বাহিনী ততদিন দুর্জয় ও অপরাজেয় গতিতে এগিয়ে গেছে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে গোটা পরিস্থিতি ভিন্নরূপ ধারণ করলো। মুসলমানেরা যে শুধুমাত্র অপরের বন্ধন-শৃঙ্খলকে উন্মোচন করতে ব্যর্থ হল তা-ই নয়, বরং তারা নিজেরাই শৃঙ্খলিত হয়ে গেল। সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় এককালে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতির মধ্যে অনৈক্য এবং বিভেদও শুরু হলো। তারা বিভক্ত হয়ে গেল আরব, আযম, উত্তর আরব, দক্ষিণ আরব, বারবার প্রভৃতি দল-উপদলে। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহের ফলে স্বীয় মান-মর্যাদা, স্বাধীনতা সংরক্ষণে তাদের সুউচ্চ চেতনাগত মনোভাবেরও তিরোধান ঘটলো।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের অজেয় প্রতিরক্ষা শক্তি এবং এরই ভিত্তিতে বিস্ময়কর বিজয়ের পেছনে এমন কোনও পারলৌকিক ফর্মুলা ছিলো না, যা আবৃত্তি করায় ম্যাজিকের মতো ফল পাওয়া গেছে। বরং তখনকার মুসলিমদের মনে প্রতিরক্ষা চেতনা ছিলো খুবই প্রবল ও স্পষ্ট। এই প্রেরণাই তাদেরকে উন্নতমানের যোদ্ধা আর গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে অগ্রসর সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছিল।
ইতিহাসের শিক্ষা থেকে জানা যায়, মুসলিমগণ প্রতিরক্ষা ধারণার মূল প্রেরণা থেকে সরে আসার মাধ্যমেই সূচিত হয় পরাজয়, বিপর্যয়, অধঃপতন। যে নিয়ম-পদ্ধতি বা কৌশল-কর্মপন্থার বদৌলতে তারা সকলের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, সেই সূত্রগুলোর পেছনের চেতনাগত বা আদর্শিক প্রণোদনা না-থাকায় অচীরেই সেগুলোই অকার্যকর প্রমাণিত হলো। শাসক মুসলিমগণ শাসিতে আর স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পরাধীনে পরিণত হলো। যে বিপর্যয়ের ধারা এখনও অব্যাহত গতিতে চলছে।
মূলত এটাই ইতিহাসের শিক্ষা এবং যুগ যুগ ধরে মানবেতিহাসে এই শিক্ষারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যা সতর্কবাণীরূপে আল-কোরআন বার বার উল্লেখ করেছে এই বলে যে, যারা সবচেয়ে বেশি যোগ্য, তুলনামূলকভাবে যাদের উপযুক্ততা বেশী, আল্লাহ তাদের উপরই পৃথিবীর নেতৃত্ব-শাসনক্ষমতা অর্পণ করেন এবং যতদিন তারা আল্লাহর আনুগত্যের সঙ্গে তাদের জন্য নিদের্শিত যোগ্যতা ধরে রাখতে পারবে, কেবলমাত্র ততদিনই এই সুযোগ পাওয়া যাবে। প্রতিরক্ষার মতাদর্শিক ও ধারণাগত ভিত্তিভূমি প্রস্ত্তত করবার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে এই অমোঘ সত্য মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আগ্রাসনমূলক বাস্তবতায় আমাদের স্বাধীন, আত্মসম্মানজনক ও নিরাপদ বেঁচে থাকার তাগিদেই।
[প্রবন্ধটি ৫ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।]

তথ্যপঞ্জি
• আল কোরআন।
• সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী (২০০২), তাফহীমুল কুরআন, ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী।
• সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী, ঈমানের হাকিকত।
• লে. ক. এম.এম কোরেশী (২০০৩), গৌরবদীপ্ত জিহাদ, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
• জেনারেল আকবর খান (১৯৮৪), ইসলামে প্রতিরক্ষা কৌশল, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
• সৈয়দ আমীর আলী (২০০৫), দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, মোহাম্মদ দরবেশ আলী খান অনুদিত, ঢাকা: প্যাপিরাস।
• সৈয়দ আমীর আলী (২০০০), আরব জাতির ইতিহাস ( অ্যা শর্ট হিস্ট্রি অব দ্য সারাসেন্স), রেয়াজুদ্দিন অনুদিত, ঢাকা: প্যাপিরাস।
• হারুনুর রশীদ (১৯৯৯), রাজনীতিকোষ, ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স।
• মাহফুজ পারভেজ (২০০৯), ‘‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস: কতিপয় ঐতিহাসিক-তত্ত্বগত সংযোগ সূত্র’’, সেমিনার প্রবন্ধ, ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
• মাহফুজ পারভেজ (২০০০), একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ, ঢাকা: গতিধারা।
• মাহফুজ পারভেজ (২০০৬), ‘‘বিশ্বায়ন: ইসলাম ও বাংলাদেশ’’, সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৩-২০০৫, ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
• মাহফুজ পারভেজ (২০০৬-ক), ‘‘যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদ’’, সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৩-২০০৫, ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
• উরকুহার্ট, ইসলাম অ্যাজ অ্যা পলিটিক্যাল সিস্টেম
• ড্রেপার (১৯৭৮), হিস্টি অব ইনটেলেকচ্যুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব ইউরোপ
• Muhammad Abdullah Enan (2002), Decisive Moments in the History of Islam, New Delhi: Goodword Books.
• Mahfuz Parvez (2006), Management of Ethnic Conflicts in South Asia: A Comparative Study of Tamil and Chittagong Hill Tracts Problems, Ph.D Dessertation, Chittagong: University of Chittagong, Bangladesh.
• Fisher, Simon (2000), Working with Conflicts: Skills and Strategies for Action, London: Zed Books.
• Ayoob (1996), “State-Making, State-Building and State-Failure: Explaining the Roots of ‘Third World’ Insecurity” in Lue Van de Goor et. Al. (eds.), Between Development and Destruction: An Enquiry into the Causes of Conflict in Post-colonial States, London: Macmillan.
• Ryan, Stephen (1995), Ethnic Conflict and International Relations, London: Dartmouth Publishing Company.
• Phadnis, Urmila (1990), Ethnicity and Nation-building in South Asia, New Delhi: Sage Publications.
• Holsti, Kalevi J. (1991), Peace and War: Armed Conflicts and International Order 1648-1989, Cambridge: Cambridge University Press.
• Ruqaiyyah Waris Maqsood (2003), A Basic Dictionary of Islam New Delhi: Goodword Books.
• Luard, Evan (1986), War in International Society: A Study in International Sociology, London: Tauris.
• Frederic F. Clairmont, (2005), “Iraq: The Nemesis of Imperialism”, Economic and Political Weekly, July 16, 2005.

 

ফুট নোটঃ

. প্রতিরক্ষার মতো একটি জটিল, বিশেষায়িত ও টেকনিক্যাল বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। পাঠক-সাধারণের কাছে এই জটিল ও প্রায়-অনালোচিত বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে অতিক্রম করতে হয়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও। টীকা-টিপ্পনী, ফুটনোট ও রেফারেন্সের গতানুগতিক ধারার প্রতি যেমনভাবে অনুগত থাকতে হয়েছে, তেমনিভাবে সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হয়েছে যাতে প্রবন্ধটি যান্ত্রিকতার সৃষ্টি না-করে; সাধারণ পাঠকদের জন্য পাঠটি কষ্টকর না-হয়; প্রবন্ধের কলেবর অপরাপর বিষয়াবলীর অন্তর্ভূক্তিতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে না-যায়। উল্লেখ্য, প্রতিরক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনাকালে খুবই স্বাভাবিকভাবে এসে আরও যোগ দিচ্ছে বহু প্রাসঙ্গিক বিষয় ও প্রসঙ্গ এবং সেসবের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। এতে ‘ইসলামে প্রতিরক্ষার ধারনা’ বলতে মূলত যে কথা বুঝায়, সেটা বিপুল আলোচনার আড়ালে অস্পষট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এবং দেখা যাচ্ছে যে, অনেক কথার ভিড়ে আসল কথাটিই চাপা পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে আমি বেশ কিছু রেফারেন্স গ্রন্থের অসংখ্য রেফারেন্সকে ঘেঁটে এ বিষয়ে একটি সামারি বা সারমর্ম ছেকে আনার চেষ্টা করেছি সাধারণ পাঠকের প্রয়োজনীয়তা ও বিদ্যমান বাস্তবতাকে সামনে রেখে। গুরু-গম্ভীর আলোচনার বদলে সহজ-সরল-সাধারণভাবে এই জটিল এবং কম-আলোচিত অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়টিকে উপস্থাপন করাই আমি জরুরি মনে করেছি। আর গবেষণা বলতে কেবলমাত্র টীকা-টিপ্পনী, ফুটনোট ও রেফারেন্সের জটিল-যান্ত্রিকতার বদলে প্রাঞ্জলভাবে একটি বিষয়কে অনুধ্যান করাকেও গন্য করা হয়। মূল কথা হলো, যে প্রসঙ্গে আলোচনা, সেটা তুলে ধরা কতটুকু সার্থক হলো, সেটাই। একটি নতুন আলোচনার সূত্রপাতকালে সর্বাংশে সফলতার দাবি অবান্তর হবে। সফলতা তখনই পরিপূর্ণ হবে, যখন সাধারণ পাঠক বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে এবং এ বিষয়টিকে নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনায় প্রবৃত্ত হবেন। যারা এ ব্যাপারে অগ্রসর পড়াশোনা এবং গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য প্রবন্ধের শেষে সংযুক্ত গ্রন্থপঞ্জি বিশেষভাবে কাজে লাগবে বলে আশা করি। তবে যেসব টীকা-টিপ্পনী, ফুটনোট ও রেফারেন্সের উল্লেখ না-করলেই নয়, সেগুলো সম্পর্কে আমি প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিক স্থানের ধারাবাহিকতা ও লেখার গতি ক্ষুণ্ণ না-করে পাদটীকায় প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা-অর্থ-তথ্য-নিদের্শনা-ইঙ্গিত উল্লেখ করে মূল বিষয়ের প্রতি সাধারণ পাঠকের মনোযোগ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে সচেষ্ট হয়েছি এবং প্রয়োজনীয়-প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তাদের আগ্রহ মিটানোরও সংক্ষিপ্ত ব্যবস্থা রেখেছি।
. জেহাদের আলোচনা ছাড়া ইসলামে প্রতিরক্ষার ধারনাটি অস্পষ্ট থেকে যাবে। আবার শুধু জেহাদ নিয়ে তত্ত্বগত বিশ্লেষণ মূল আলোচনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। ফলে আলাদাভাবে এখানে জেহাদ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সাধারণভাবে জেহাদ বা জ্বিহাদ হল ধর্মযুদ্ধ বা আল্লাহ এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিদের্শিত পথে যুদ্ধ। অধিকাংশ ধর্মতত্ত্ববিদের মতে, জেহাদের উদ্দেশ্য হলো সমগ্র বিশ্বব্যাপী আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করা, স্বার্থপর ও যুলুমবাজ অত্যাচারীর কর্তৃত্বের অবসান করা, মানবজীবনের সকল দিককে পরিব্যাপ্ত করে আল্লাহর বিধান প্রবর্তন করা এবং সর্বোপরি মানুষের গোলামি থেকে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা। এই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে ইসলাম প্রতিটি মুসলিমকে কুফর-শিরক-বিদআত এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতন-বৈষ্যমের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নিদের্শ দেয়। পবিত্র কোরআন অনুযায়ী জেহাদ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ বা অপরিহার্য কর্তব্য। বিস্তারিত, হারুনুর রশীদ (১৯৯৯)। আরও বিস্তারিতভাবে বললে: The word ‘Jihad’ comes from the word ;Jihada’ which means to strive, struggle, exert oneself, being willing to strive and fight in the way of good against evil. It denotes striving in the cause of Allah (SWT) in the widest sense, including moral effort. The Great Jihad or Jihad-an-Nafs is against one’s own lower tendencies (such things as lust, greed, pride, dishonesty etc.). it means self-purification of one’s own passionsa and weakness. According to Holy Quran (29:6). There is also the Jihad in relation to the outer world which involves helping others, teaching, improving social conditions and so forth as the Quran says: (49:15). Finally, there is the military sense of the word, which must be justified as a ‘Holy War’ it must be in defence of the cause of Allah (SWT), and not for conquest; be to restore peace or freedom of worship or freedom from tyranny. See, Ruqaiyyah Waris Maqsood (2003).
. শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, দাসত্ব, বৈষম্য ইত্যাদির কবল থেকে মুক্তির জন্য কিংবা বিদেশী আক্রমণ, দখল, সম্প্রসারণ বা আথিপত্যের কবল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য কিংবা সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে কোনও উপনিবেশ-অধীনস্থ দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যুদ্ধই ন্যায়-যুদ্ধ, যার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত সফলভাবে ও সর্বপ্রথম লক্ষ্য করা যায় রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী-দখলদার অপশক্তির বিরুদ্ধে মুসলিমদের ন্যায়-যুদ্ধের ইতিহাসে।
. যে-সকল ব্যক্তি বা জাতি বা দেশ কোনও শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করে না, বরং মনে করে যে একমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভবপর, তাদেরকে বলা হয় যুদ্ধোন্মাদ আর তাদের এহেন যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে বলা হয় যুদ্ধোন্মাদনা, যেমন আরবের কাফের-মুশরিকগণ, পারস্যের খসরু, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, হিটলার, মুসোলিনি, স্ট্যালিন, জর্জ বুশ।
. সংজ্ঞাগত আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধ হলো দুই বা ততোধিক দেশের সশস্ত্র সংঘর্ষ। আধুনিককালে প্রতীয়মান হয়েছে যে, যুদ্ধ রাজনীতিরই একটি বর্ধিত ও সশস্ত্ররূপ। বর্তমানে কোনও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বা রাষ্ট্র বা মতাদর্শগত সঙ্কট যখন আর শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভবপর হয় না, তখনই শুরু হয় সশস্ত্র সংঘাত বা যুদ্ধ।
. প্রাচীনকাল বাদ দিয়েও কেবলমাত্র উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কয়েক শ‘ ছোট ও বড় যুদ্ধ এবং সংঘাতের বিবরণ পাওয়া সম্ভব। এগুলো দেশে বা দেশের ভেতরে---উভয় পর্যায়েই সংঘটিত হয়েছে। বিস্তারিত জানতে, দেখুন,
Mahfuz Parvez (2006), Fisher (2000), Ayoob (1996), Holsti (1991), Phadnis (1990), Ryan (1995) and Luard (1986).
. বিস্তারিত জানতে দেখুন, মাহফুজ পারভেজ (২০০৬).
Frederic F. Clairmont, “Iraq: The Nemesis of Imperialism”, Economic and Political Weekly, July 16, 2005, p. 2.
বিস্তারিত জানতে দেখুন, মাহফুজ পারভেজ (২০০৬-ক.)
জাতিসংঘের সাফল্য-ব্যর্থতার বিস্তারিত বিবরণ, দেখুন, মাহফুজ পারভেজ (২০০০).
বিস্তারিত জানতে দেখুন, মাহফুজ পারভেজ (২০০৯).
. স্বীয় আত্মরক্ষা এবং প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ বা যুদ্ধ/জিহাদ সংক্রান্ত কোরআনের ভাষ্যসমূহ পরবর্তীতে যথাস্থানে আলোচিত হয়েছে।
. এখানে বিষয়টি খুবই সংক্ষিপ্তভাবে আলোচিত হয়েছে। বিস্তারিত দেখুন সীরাতের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহে।
. বিস্তারিত দেখুন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, তাফহিমুল কোরআন (৯ম খন্ড), ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ২০০২, পৃ. ৬০.
. ইসলামী দাওয়াত জাহেলিয়াতের সমাজকে কিভাবে ইসলামী সমাজে রূপান্তরিত করে এবং ঈমানে দীপ্ত মানবসম্পদের বিকাশ ঘটায়, দেখতে, পড়ুন, সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী, ঈমানের হাকিকত।
. পবিত্র মক্কা ও মদীনা-কেন্দ্রীক ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শিক মানদন্ড রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনে রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আজমায়িনের সময়কাল পর্যন্ত অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে বিকষিত হয়েছে। বিস্তারিত দেখুন, সীরাতের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী।
. এই বিষয়ে পবিত্র কোরআনের যুদ্ধ-জিহাদ-সংক্রান্ত আয়াত বা নিদের্শনা বিশেষভাবে প্রণিধান্যযোগ্য, যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের জন্য, দেখুন, সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী, তাফহিমুল কোরআন।
. এখানে পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ সরাসরি উল্লেখ না করে, এর মূল বক্তব্যটি তুলে ধরা হয়েছে। বিস্তারিত আয়াতসমূহ দেখুন: সূরা আল বাকারা, আয়াত ২১৬; আল ইমরান ১৯০, ১৯১, ১৯৩, ১৫৪, ১৭৭, ২১৭, ২৪৪, ১৩, ১২১, ১২৮, ১৫১, ১৫২, ১৫৮, ১৭২; আন নিসা ৭৪, ৭৬, ৮৪, ৯৫, ৯৬, ১০২; আন ফাল ৭-১৯, ৩৯, ৫৭, ৬০, ৬৫, ৬৬, ৬৭; আত তাওবা ৫, ১২-১৬, ২৪-২৬, ২৯, ৩৫, ৩৮-৪২, ৭৩, ১২৩; হাজ্জ ৩৯, ৪১, ৭৮; ফোরকান ৫২, আন কাবুত ৬৯, আহযাব ২৫-২৭; মুহাম্মদ ৪, ২০; ফাতাহ ২৫; হুজুরাত ১৫; হাদীদ ১০, ১৯; মোমতাহেনা ১, ৮, ৯; সফ ৪, ১১; তাহরীম ৯; মোযযাম্মেল ২০.
. ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধ এবং এর বিজয়-কৌশল এক-একটি যুদ্ধের নিরিখে পর্যালোচনা করা হলে উপরোক্ত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়।
. বিভিন্ন সামরিক বিশেষজ্ঞ ও ইসলামের প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ বিষয়ের পন্ডিতগণের মতামত, যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও কর্মের নিরিখে প্রণীত হয়েছে, তারই ভিত্তিতে রচিত। বিস্তারিত জানতে, দেখুন, লে. ক. এম.এম কোরেশী (২০০৩), জেনারেল আকবর খান (১৯৮৪)।
. দ্রষ্টব্য, সীরাতের গ্রন্থসমূহ এবং ইসলামের ইতিহাসের সকল গ্রন্থেই এ বক্তব্যের সত্যতা মিলবে। উদাহরণ স্বরূপ, হুনায়ন বা হাওয়াযিন যুদ্ধ-এর কথা উল্লেখ করা যায়। মক্কার কাফের-মুশরিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিজয়ের অর্ধ মাসের মধ্যেই আরবের নবউত্থিত শক্তি ইসলামকে
পরাজিত করার জন্য যিল হিজাজের উপত্যকায় বসবাসকারী বনী হাওয়াযিন ও বনী ছাকীফের ঐক্যবদ্ধ বাহিনী হুনায়নের প্রান্তরে সমবেত হয় এবং বিপুলতা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
. বিস্তারিত দেখুন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, তাফহিমুল কোরআন (৯ম খন্ড), ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ২০০২, পৃ. ৫৯.
. এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ‘মৃত সাগর’-এর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে মু‘তা নামক স্থানে ৮ হিজরিতে (৬২৯ সাল)। যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে সাহসিক নেতৃত্বের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেনাপতি খালিদকে সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তলোয়ার খেতাবে ভূষিত করেন।
. তাবুকের যুদ্ধে কোনরূপ মুকাবিলা হয় নি। কোন রক্তপাত ও জীবনহানি ঘটে নি। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, বিজয় ও সাফল্য দু‘টিই হাসিল হয়েছে। এর অন্তর্নিহিত রহস্য এই যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুর বিরুদ্ধে এমনই কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করলেন যে, প্রতিপক্ষ কিছুই বুঝতে পারলো না। ফলে তিনি যখন এসে পৌঁছালেন, তখন শত্রুপক্ষ অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কিছুই করতে পারলো না। তিনি পরাজিত পক্ষের প্রতি কোনরূপ নৃশংসতা করা তো দূরের কথা, তাদেরকে ইসলামী সীমানার নিরাপত্তার মধ্যে নিয়ে আসলেন। এ যুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে মদীনা ও মক্কাকেন্দ্রীক ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত একদিকে ইরান এবং অন্যদিকে মিসর রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
. এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন উরকুহার্ট নামে একজন অমুসলিম তার ইসলাম অ্যাজ অ্যা পলিটিক্যাল সিস্টেম নামক গ্রন্থে।
. সৈয়দ আমীর আলী (২০০৫: ২৬১)
. আল কোরআন, সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ১৯০-১৯৩.
. হিরাবাসীদের এলাকা বিস্তৃত ছিল বিরাট ভূখন্ড নিয়ে---ফোরাত নদীর তীর থেকে পশ্চিম দিকে ইরাকি মরুভূমির অনেকখানি নিয়ে গাস্সানি আরবদের পশুচারণ ভূমির প্রায় সীমা পর্যন্ত। গাস্সানিরা আবার আনুগত্যের সূত্রে আবদ্ধ ছিল বাইযান্টাইনদের সাথে। বিস্তারিত, দেখুন, সৈয়দ আমীর আলী (২০০০)।
. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীনরা কোন শত্রুপক্ষকেই তাদের সীমাহীন শত্রুতা ও জুলুমের জন্য প্রথমেই আক্রমন করেন নি। প্রতিপক্ষকে দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করা হতো।
. ৬৩৭ সালের মার্চ মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এতে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের ফলে সহস্রবর্ষব্যাপী প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের স্বৈরশাসনের অবসান হয় আর ইসলামের বিজয় পতাকার সুশীতল শান্তির ছায়াতলে বিপুল-বিশাল অঞ্চলের লাখো নির্যাতিত মানুষের পরম আশ্রয় লাভের সুযোগ ঘটে।
. মধ্যযুগের খ্রিস্ট জগতে প্রচলিত শাস্তি দেওয়ার জন্য মানুষের দেহ টানটানভাবে আটকে রাখার যন্ত্র।
. মধ্যযুগের খ্রিস্ট জগতে পুড়িয়ে মারার জন্য মানুষকে বেঁধে রাখার শক্ত খুঁটি।
. যে রেকর্ড বৌদ্ধ-মুসলিম নিধনের মাধ্যমে ভারতের হিন্দুরা আর মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম নিধনের মাধ্যমে ইহুদিরা স্পর্শ করেছে।
. গলায় আটকানোর জন্য ফাঁকওয়ালা তক্তাখন্ডযুক্ত যন্ত্র-বিশেষ, উঁচু খুঁটির সঙ্গে লাগানো থাকে, যেখানে ঝুলিয়ে বিরুদ্ধবাসী মানুষকে লটকিয়ে রেখে নির্যাতন করা হতো।
. শুধু পর ধর্ম নয় বা মুসলিম-ইহুদিদের ক্ষেত্রেই নয়, নিজ ধর্ম ও জাতিতে ভিন্ন ধর্মবলম্বীদের প্রতিও ভয়াবহ যুদ্ধ ও নির্যাতন চাপিয়ে দেওয়া হয়। শার্লেমানি কর্তৃক স্যাক্সন ফ্রিসিয়ান ও অন্যান্য জার্মান উপজাতিগুলোকে হত্যা করা, আরিয়ান ও পলিসিয়ানদের পুড়িয়ে মারা, আলবিজেন্স ও হিউগেনটনদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে মারা, ম্যাগডিবার্গ ও রোম নগরের হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন, কালভিন্পন্থী ও লুথারপন্থীদের পারস্পরিক রক্তপাত, কালোদের নিধন---সবই হয়েছে খ্রিস্ট জগতে ভিন্নমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতার ফলস্বরূপ।
. ড্রেপার (১৯৭৮)
. সৈয়দ আমীর আলী (২০০০)
. বিস্তারিত দেখুন, লে. ক. এম.এম কোরেশী (২০০৩), জেনারেল আকবর খান (১৯৮৪), সৈয়দ আমীর আলী (২০০৫), Muhammad Abdullah Enan (2002).