ভূমিকা

দেশপ্রেম এবং আত্ম মর্যাদাবোধ স্বাধীন সার্বভৌম যে কোনও দেশের জন্য একটি সম্পদ। দেশের সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সরকারী কর্মকতা-কর্মচারী এবং রাষ্ট্রনায়কদের দেশপ্রেম দেশের অস্তিত্ব, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। এদের যে কোন একটি শ্রেণীর দেশপ্রেমে ঘাটতি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এবং সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ প্রেক্ষিতে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে দেশ প্রেমকে সর্বত্র সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়, দেশপ্রেমিকরা শ্রদ্ধার পাত্র হন এবং যাদের দেশ প্রেম নাই তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরা সর্বকালে, সর্বযুগে নিন্দার পাত্র। আত্মমর্যাদাবোধ দেশ প্রেমিকদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই দুই এর সমন্বয় মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায় এবং আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে মুকাবিলা করতে উজ্জীবিত করে। দেশপ্রেম ছাড়া মুসলিম মিল্লাতের কল্পনা করা যায় না। একটি আরবী প্রবচনে বলা হয়েছে ‘হববুল ওয়াতন মিনাল ঈমান’ অর্থাৎ দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ। বিগত শতাব্দীসমূহে এই উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের প্রতিকূল শক্তির মুকাবিলায় দেশপ্রেম ও ঈমানী দায়িত্ব পালনের বহু অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং এখনো স্থাপন করে চলেছে। তাদের সাফল্য গাথার বহু চিত্র ইতিহাস গ্রন্থ ও সাহিত্যের পাতায় ছড়িয়ে আছে এবং যুগে যুগে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করছে। ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতেও দেশ প্রেমের অনুরূপ নজির পাওয়া যায়। রামায়নের একটি আখ্যানকে কেন্দ্র করে কবি মধুসুদন দত্ত প্রণীত রূপকাশ্রয়ী কাহিনী মেঘনাদবধ কাব্যেও এর নজির রয়েছে। এই কাব্যে কুসুমদাম সজ্জিত দীপাবলী তেজে/উজ্জলিত নাট্যশালা সম আছিল এ মোর সুন্দরী পুরী- অর্থাৎ রাবনের সোনার লংকা বহিরাগত শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে লন্ডভন্ড ও ধ্বংস প্রাপ্ত হতে দেখি, কিন্তু রাবন এর প্রতিকার করতে পারছেন না। তার দেশপ্রেম শোর্যবীর্য কোনও কাজে আসছেনা। এই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য অস্ত্রবল, সৈন্যবল ও অর্থবলের তার কোনও কমতি ছিলনা। কিন্তু তা সত্বেও লংকায় ‘একে একে শুকাইছে ফুল, নিভিছে দেউটি’। শত্রুর আক্রমণ আর তারই পিতৃব্য ঘরের শত্রু বিভীষণ রাবনের কপালে কলংক তিলক পরিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায়ও রাবন ভাঙ্গছে কিন্তু মচকাচ্ছেনা। তারস্বরে সে জানিয়ে দিচ্ছে যে, পরবশ্যতা সে কিছুতেই মানবেনা। দেশ প্রেম তার এতই শানিত এবং উচ্চকিত, আত্ম-মর্যাদাবোধ তার এতই প্রবল যে, কোন ভাবেই সে তা বিসর্জন দেবেনা, ব্যক্তি স্বার্থে তো নয়ই। এখানে আত্ম-মর্যাদাবোধ ও দেশ প্রেমকে এই কাহিনীর মর্মবাণী হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর আগে ১৯৪৭ সালে আগষ্ট মাসে আমরা বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম বারের মতো পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করি এবং ২৪ বছর পর্যন্ত পাকিস্তানী হিসেবে আমাদের পরিচয় ছিল। কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমাদের পূর্ব পুরুষরা রক্ত দিয়ে পাকিস্তান অর্জন করেছিলেন তা অর্জিত না হওয়ায় এবং শাসক শ্রেণীর অবিমৃশ্যকারিতায় ঐ দেশটি টিকেনি। তার ধ্বংসস্তুপের উপর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গত ৩৮ বছরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে এখনো প্রশ্ন উঠছে এবং পাশাপাশি এ দেশের নাগরিকদের দেশ প্রেম নিয়েও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এবং এ প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবে স্বাধীনতার হেফাজতের পন্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা, অর্থ, তাৎপর্য, গুরুত্ব ও প্রকারভেদ, দেশপ্রেম উজ্জীবনে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা, দেশপ্রেমের অপব্যবহার, বিভিন্ন দেশে দেশপ্রেমের মাত্রা, ইসলামের দৃষ্টিতে দেশপ্রেমের মাপকাঠি, বাংলাদেশে দেশপ্রেমের অবস্থা এবং স্বাধীনতা সুরক্ষায় করণীয় সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।

দেশপ্রেমের সংজ্ঞা, অর্থ, তাৎপর্য, গুরুত্ব ও প্রকারভেদ
দেশ প্রেমের ইংরেজী প্রতিশব্দ Patriotism. গ্রীক Patria শব্দ থেকে Patriotism শব্দের উৎপত্তি। Patria অর্থ হচ্ছে The land of one’s fathers, কোনও ব্যক্তির পিতৃপুরুষদের জন্মভূমি। Patriotism বা দেশ প্রেমের বিভিন্ন সংজ্ঞা আছে। Weebies এর সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশ প্রেম হচ্ছে, Love for or devotion to one’s country. আবার Mike Wasdin নামক প্রখ্যাত রাজনীতি বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে Patriotism বা দেশপ্রেম হচ্ছে “a feeling of love and devotion to one’s own homeland.” এখানে হোমল্যান্ড বলতে পিতৃভূমিকে বুঝানো হয়েছে। দেশ প্রেমের প্রজ্ঞা নিয়ে খুব কম লোকই প্রশ্ন তোলেন। এটা থাকা উচিত কিনা, থাকলে এর ধরন প্রকৃতি কি হওয়া উচিত এ ধরনের প্রশ্ন সচরাচর দেখা যায় না।
বর্তমান দুনিয়ায় রাষ্ট্র হচ্ছে দেশ প্রেমের সবচেয়ে বড় সংগঠক। রাজনীতিবিদরা দেশাত্মবোধক বক্তৃতা বিবৃতি দিতে পছন্দ করেন, দেশের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য সাধারণ নাগরিকদের পরামর্শ দেন এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমসমূহ সরকারী আমলাদের পরিচালনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তোতা পাখির ন্যায় দেশ প্রেমের বুলি আওড়ায়, সরকারের বা সরকারী দলের নেতা-কর্মীদের দেশ প্রেমকে মানুষের দরজা পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়। অবশ্য খুব কম ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ দেশ প্রেমের এ ধরনের কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন; শাসক দলের প্রচারধর্মী বক্তৃতা বিবৃতি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ডকুমেন্টারী, গান বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিদেশী কালচার ও কুরুচিপূর্ণ নাটক সিনেমার প্রচার আদৌ দেশ প্রেম অথবা তাদের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূল কিনা সে সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে অবাঞ্ছিত বলে বিবেচিত কোন কোন বিষয়ে মতামত রাখার ব্যাপারে বাক ও লিখনীর স্বাধীনতাকে সীমিত বা খর্ব করার বাহানা হিসেবে দেশ প্রেমকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারী নীতি পলিসির সমালোচনা বা বিরোধিতাকে দেশ প্রেমের পরিপন্থী বা বিশ্বাস ঘাতকতা বলে গণ্য করা হয়। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটেই সম্ভবতঃ স্যামুয়েল জনসন বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “Patriotism is the last refuge of a scoundrel” অর্থাৎ দেশপ্রেম হচ্ছে পাজি বদমাশদের সর্বশেষ আশ্রয়। তার এই উক্তির মমার্থ তাৎপর্যপূর্ণ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশের প্রতি ভালবাসা বা আসক্তি থাকার প্রয়োজন আছে কিনা। কেউ কেউ মনে করেন যে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে জন্ম গ্রহণ করার ব্যাপারে কোনও ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছা অনিচ্ছা কাজ করেনা। কোনও দেশ বা এলাকায় জন্ম গ্রহণের বিষয়টি নিতান্তই আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপার। ব্যক্তির নিজের প্রতি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালবাসা থাকার যৌক্তিকতা বোধগম্য। কিন্তু দেশের প্রতি অনুরূপ নিষ্ঠা ও ভালবাসা ব্যক্তিস্বার্থের কতটুকু অনুকূল তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। সমতল ভূমি ও পাহাড়িয়া অঞ্চল কিংবা উপকূলের বাসিন্দা ও সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারীদের দেশ প্রেমের মিটার এক রকম নয়। দেশ প্রেমে ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকি এবং স্বার্থের মিল না ঘটলে দেশ প্রেম ফলপ্রসূ হয় না। আবার জাতীয় পর্যায়ে স্বার্থের বিভিন্নতা এত বেশি যে অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য ব্যক্তির স্বার্থের অনুকূল প্রমাণিত হয় না। কেননা এ ক্ষেত্রে তাকে নিজের স্বার্থের চিন্তা না করে এমন নীতি ও পলিসির প্রতি সায় দিতে হয় যা তার পছন্দ নয়। উইবিজ এর ভাষায়, “Patriotism is just a cover for collective thinking. It promotes the idea that the nation is responsible for any good that happens to the individual and the individual owes his life to the nation. Patriotism tries to assign any benefit that an individual receives not to the individuals’ acts of people, but because of the collective good of the nation. Patriotism demands that the individual subjugate his desires to the collective interest of the nations, even to sacrificing himself, family and friends. Patriotism advocates group responsibility over individual responsibility.”
কেউ কেউ মনে করেন যে দেশকে ভালবাসার যৌক্তিক কারণ থাকুক বা না থাকুক, দেশ প্রেম অধিকাংশ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রবৃত্তি বা দেশের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা তারা কিভাবে প্রকাশ করেন। দেশ প্রেম প্রকাশের বাহন কি এবং কিভাবে দেশ প্রেমিকরা প্রমাণ করেন যে অন্যদের তুলনায় তারা উত্তম এবং ভিন্ন দেশের নাগরিকদের চেয়ে তারা বেশি অধিকার ভোগ করেন। এই বিষয়টি নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে তেমনি দেশের মানুষ এবং বিদেশীদেরই বা তারা কোন দৃষ্টিতে দেখেন তাও গবেষণার বিষয়।
গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে অনেক সময় দেশ প্রেমকে (Patriotism) যুদ্ধরত জাতীয়তাবাদের একটা অংশ বলে মনে হয়। জর্জ আরওয়েলের ভাষায় Nationalism বা জাতীয়তাবাদ হচ্ছে Loyalty and devotion to a nation; especially: a sense of national consciousness exalting one nation above all others and placing primary emphasis on promotion of its culture and interests as opposed to those of other nations and supernational groups.
অপরাপর জাতিসমূহকে ছোট গণ্য করে নিজের পিতৃভূমির শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মধ্যে কেউ কেউ দেশ প্রেমের অভিব্যক্তি দেখতে পায়। তাদের দৃষ্টিতে বিদেশীরা মনুষ্য পদ বাচ্য নয় অথবা তারা মানুষ হলেও অস্পৃশ্য বা ছোট জাতের। অতীতে দেশ প্রেমের এই বর্ণবাদী ধারণা বিশ্বে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ইহুদী ও নাৎসিরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দেশ প্রেমিকের মধ্যেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বস্ত্ততঃ নিজ দেশের প্রতি আসক্তি বা ভালবাসা এবং ভিন দেশের প্রতি ঘৃণা অথবা নিজ দেশের যারা সরকারী দলের লুটপাট কিংবা বিতর্কিত রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা করে তাদের শত্রু গণ্য করার নাম দেশ প্রেম নয়। Edward Abbey’র মতে If patriotism has any value it would be as a friendly competition between equals who have the same rights where one hopes that all competetors do well but hopes that his side does the best. A patriot must always be ready to defend his country not only against foreign aggressors but also against his government.
রাষ্ট্র ও দেশপ্রেম
কোন কোন দেশের দেশপ্রেমের লালন ও পরিপুষ্টির জন্য রাষ্টীয়ভাবে My country right or wrong এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হয়। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত জওহর লাল নেহেরু এই অঞ্চলে এই মতামতের উদ্ভাবক ছিলেন। নীতি ও নৈতিকতার দিক থেকে এই মতবাদটি সর্বজন গ্রাহ্য নয়। রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একে বিকারগ্রস্ততা বলে অভিহিত করেন। Senator Carl Schulz এই শূণ্যগর্ভ মতবাদের বিপরীতে দেশ প্রেমের আরেকটি ধারণা পেশ করেছেন। তার ধারণাটি হচ্ছে My country right or wrong, if right, to be kept right, if wrong to be set right.
ন্যায়-অন্যায় যা করি আমরাই সঠিক, আমাদের যারা বিরোধিতা করে তারা দেশের শত্রু, আমাদের শত্রু এই ধারণাটি সুস্থ মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। এর ফলে ধ্বংস ও বিপর্যয় নেমে আসে, মানবতার অবমাননা হয়। জাতীয় গন্ডি পেরিয়ে এই ধারণাটি যখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপ্তি লাভ করে তখন মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ কর্তৃক ঘোষিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতি You are either with us or against us ধরনের হুমকীমূলক আহবান এবং এর পরিণতিতে মার্কিন নেতৃত্বে মিত্র দেশগুলো কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাকের ন্যায় মুসলিম অধ্যুষিত দু’টি দেশে ধ্বংসযজ্ঞের অনুষ্ঠান অন্ধ দেশ প্রেমের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সাধারণ মানুষকে দেশ প্রেমে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে, এর মধ্যে সরকারের প্রতি আনুগত্যের শপথ, পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের এসেমব্লি, স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধি, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, প্রেসিডেন্ট এবং শাসনতান্ত্রিক পদধারী ব্যক্তিরা রাষ্ট্র, সংবিধান ও আইনের প্রতি অনুগত থাকার যে শপথ বাক্য পাঠ করেন তা দেশ প্রেম বহাল রাখারই একটা পদ্ধতি বা কৌশল।
রাষ্ট্রীয় ভূমিকার প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেম সম্পর্কে স্যামুয়েল জনসন অত্যন্ত তিক্ত মন্তব্য করেছেন, তার ভাষায়, “The merits of patriotism are dubious at best. As practiced the kindest description is that patriotism is a national Psychosis where those who suffer from it can no longer determine right from wrong, and advocate that the state commit barbaric atrocities in their name. As with all other mental derangements, those who suffer from its delusional effects should not be encouraged to continue or spread their disease but seek qualified help to overcome their impairment.”
স্যামুয়েল জনসনের হতাশার কারণ সুস্পষ্ট। কোন কোন রাষ্ট্র দেশপ্রেমকে অন্যায়-অবিচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কোনও বিশেষ ইস্যু সম্পর্কিত সরকারের নীতি পলিসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সমালোচনা বন্ধ করার জন্য দেশ প্রেমকে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যমান অবস্থায় অনেকেই মনে করেন যে দেশ প্রেম স্বাধীনতা ও অবাধে মতামত প্রকাশের শত্রু। তবে প্রকৃত দেশ প্রেম ও দেশ প্রেমিকরা এ ধরনের সমালোচনার উর্ধ্বে। একজন সত্যিকার দেশ প্রেমিক তার দেশের সরকার এবং নেতৃবৃন্দের কাজ কর্মের ব্যাপারে সর্বদা প্রশ্ন তুলবেন। স্বাধীনতা প্রিয় প্রত্যেকটি মানুষ অবহিত রয়েছেন যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারই হচেছ স্বাধীনতার বড় হুমকী; চলা ফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা বিবেক ও বাক স্বাধীনতা তার হাতেই বেশি বিপন্ন হয়, বিদেশী রাষ্ট্রের কোনও নাগরিকদের হাতে নয়। আবার ক্ষমতায় থাকার জন্য কিংবা সংকীর্ণ দলীয় ও আর্থিক স্বার্থে এ ধরনের সরকারই বিদেশী শক্তির হাতে দেশের সার্বভৌমত্ব তুলে দিতে কুণ্ঠিত হয় না।
মোদ্দা কথা হচ্ছে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর, স্বার্থহীন যে কোনও কর্মকান্ড দেশ প্রেমের অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয়া, সৈন্যদের রসদ ও অস্ত্র যোগানে সাহায্য করা এবং তাদের মনোবল অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা চালানো প্রভৃতি হচ্ছে দেশ প্রেমের উল্লেখযোগ্য কিছু দিক ।
দেশপ্রেমের রাজনৈতিক অপব্যবহার কিভাবে বিপদ ডেকে আনে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে এডলফ হিটলার। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে তিনি ক্ষমতা দখল করেন এবং ডিক্টেটারে পরিণত হন। তার দেশপ্রেমের অন্ধত্ব, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের মতবাদ এবং সম্প্রসারণ ও আধিপত্যবাদী ধ্যান ধারণা ও অহংবোধ, প্রতিবেশী দেশসমূহের উপর আক্রমণ ও জবর দখল সারা দুনিয়াকে যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দেয়। নিজ দেশের ভূখন্ড সম্প্রসারণ আধিপত্য বিস্তার অথবা সম্পদ বা বাজার দখলের জন্য অন্য দেশের উপর হামলা দেশপ্রেম নয়। মাইক ওয়াজদিনের ভাষায়,
“Patriotism embodies two things: selflessness, which virtually everyone admires, plus a belief that we owe a greater allegiance to our fellow citizens than to ourselves, or a foreign countrymen”, অর্থাৎ দু’টি উপাদান নিয়ে দেশপ্রেম গঠিত। একটি হচ্ছে, নিঃস্বার্থপরতা যা কার্যতঃ সকলেই ভালবাসেন। আরেকটি হচ্ছে এই বিশ্বাস বা ধারণা যে আমাদের নিজের বা বিদেশীদের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষের প্রতি অধিকতর আনুগত্য এবং দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। বিদেশীদের তুলনায় দেশের মানুষ অধিকতর প্রিয় ও কাছের কিনা বাস্তব জীবনে প্রায়শঃই এই প্রশ্নটির মুখোমুখী হতে হয়। এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনেক দেশের অভিবাসন আইন অনুযায়ী নিছক জন্ম সূত্রেই কোনও ব্যক্তি একটি দেশের নাগরিক হতে পারেন এবং সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা পাবার যোগ্য বিবেচিত হন। কিন্তু বিদেশীরা তা পান না। অবশ্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য এবং দেশের মানুষের প্রতি আনুগত্য ও দায়িত্ব কর্তব্যের ব্যবধান নিয়ে সর্বত্র বিতর্ক রয়েছে। এর অবসানের চেষ্টাও চলছে।
সংশ্লিষ্ট ভূখন্ডে জন্ম না হলেও কোনও ব্যক্তি সে দেশের প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমিক হতে পারেন না অথবা সে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারেন না তা নয়। ভিন দেশে জন্ম গ্রহণ করেও অন্য দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় লড়াই করেছেন অথবা প্রাণ দিয়েছেন ইতিহাসে এর অনেক নজির রয়েছে। Marquis de Lafayette নামক একজন ফরাসী বীর আমেরিকার ১৩টি বৃটিশ কলোনীর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। দেশাত্মবোধক কাজকে দু’ভাগে দেখা যায়, বিস্তৃত অর্থে এ হচ্ছে এমন একটি কাজ যার মধ্যে ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থ নেই এবং যা থেকে রাষ্ট্র উপকৃত হয়। সংকীর্ণ অর্থে বিশেষভাবে দেশপ্রেমের অনুভুতি থেকে উৎসারিত নিঃস্বার্থ যে কোন কাজই হচ্ছে দেশাত্মবোধক কাজ।
দেশপ্রেমের অনুভূতি সম্পর্কে দার্শনিক Alasdair MacIntyre ‘Is Patriotism a ঠরৎঃঁবহ শীর্ষক গবেষণা পত্রে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার ভাষায়ুOne explanation that has been proposed is that such feelings result in the long run, from kin selection. Our ancestors certainly lived in small groups of genetically related individuals. Feelings of intense loyalty to one’s own group might have led individuals to take actions that were poorly justified on grounds of self interest but helped the group as a whole. Since genes tend to have been shared by the entire group, and cooperation likely was critical to group survival, a propensity to experience feelings of loyalty to the group was probably favoured by natural selection.” Alasdair-এর এই ব্যাখ্যাটিতে ডারউইনের থিওরীর উপাদান পাওয়া যায়। এখানে রক্ত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক দেশপ্রেমের মানদন্ড। এর বাইরে আদর্শের সম্পর্ক যে দেশপ্রেমের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক তা তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে বলে মনে হয়।
দেশপ্রেমের পরিমাপ
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দেশপ্রেম পরিমাপের লক্ষ্যে বিভিন্ন সমীক্ষা পরিচালনার নজির রয়েছে। সরকারের নীতি পলিসির সংস্কার বা পুনর্গঠন ছিল এই সমীক্ষাসমূহের মূল উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর The Correlates of War Project নামক ইউরোপীয় দেশসমূহের একটি প্রকল্পের তরফ থেকে এ ধরনের একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। এই সমীক্ষা যুদ্ধের তীব্রতার সাথে দেশপ্রেমের একটা সম্পর্ক চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।
আবার এও দেখা গেছে যে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন হয়। এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে জার্মানদের দেশপ্রেম ছিল তুঙ্গে কিন্তু সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী তাদের অবস্থা এখন সর্ব নিম্নে এসে পৌঁছেছে। World Value Survey এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেশপ্রেমের স্কোর বা মাত্রা সম্পর্কে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ‘‘আপিন কি আপনার দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে গর্বিত’’ এই প্রশ্নের উত্তরকে ভিত্তি করে এই রিপোর্টটি তৈরী করা হয়েছে এবং এর স্কোর সর্ব নিম্ন ১ (গর্বিত নই) থেকে সর্বোচ্চ ৪ (অত্যন্ত গর্বিত) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সমীক্ষায় প্রাপ্ত গড় দেশওয়ারী ফলাফল নিম্নরূপঃ

দেশের নাম ১৯৯০-১৯৯২ সালের
সমীক্ষার স্কোর দেশের নাম ১৯৯৫-১৯৯৭ সালের
সমীক্ষার স্কোর
আয়ারল্যান্ড ৩.৭৪ ভেনেজুয়েলা ৩.৯২
যুক্তরাষ্ট্র ৩.৭৩ দক্ষিন আফ্রিকা ৩.৭৩
ভারত ৩.৬৭ ভারত ৩.৭২
দক্ষিন আফ্রিকা ৩.৫৫ যুক্তরাষ্ট্র ৩.৭০
কানাডা ৩.৫৩ পেরু ৩.৬৮
স্লোভেনিয়া ৩.৪৬ স্লেভেনিয়া ৩.৬৪
স্পেন ৩.২৮ পোল্যান্ড ৩.৫৫
ডেনমার্ক ৩.২৭ অষ্ট্রেলিয়া ৩.৫৪
ইতালি ৩.২৫ স্পেন ৩.৪০
সুইডেন ৩.২২ চিলি ৩.৩৮
ফ্রান্স ৩.১৮ আর্জেন্টিনা ৩.২৯
ফিনল্যান্ড ৩.১৭ সুইডেন ৩.১৩
মলডোভা ২.৯৮
বেলজিয়াম ৩.০৭ জাপান ২.৮৫
নেদারল্যান্ড ২.৯৩ রাশিয়া ২.৬৯
জার্মানী ২.৭৫ সুইজার‌্যান্ড ২.৫৯
গড় ৩.২৬ লিথুয়ানিয়া ২.৪৭
লাটভিয়া ২.১০
জার্মানী ১.৩৭
গড় ৩.১২

উপরোক্ত রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে কোনও পরিসংখ্যান নেই। এ প্রেক্ষিতে এদেশের মানুষের দেশপ্রেমের স্কোর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা কঠিন। তবে যেহেতু সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অগণিত মানুষের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জতের বিনিময়ে এই দেশটি অর্জিত হয়েছে সেহেতু স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় যে, আমাদের দেশপ্রেমে খাদ বা ঘাটতি নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম ওপি ওয়ানের মাধ্যমে অভিবাসন কর্মসূচী শুরু করেছিল তখন বাংলাদেশ থেকে এক কোটি যুবক সে দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিল। এই অবস্থা দেখে কেউ কেউ তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি তাদের এই আচরণকে দেশপ্রেম বর্জিত কোনও পদক্ষেপ বলে মনে করি না বরং জীবিকা অর্জনের উৎস সন্ধানের প্রয়াস হিসেবে দেখি। অভিবাসন পেলেও তারা জন্মভূমির খেদমত করতে পারেন। এতে কোনও বাধা থাকার কথা নয়।
দেশ প্রেমের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত ইনসাফ ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা, উলুল আমর এর আনুগত্য, পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃ্ত্ব প্রতিষ্ঠা, জনগণের সংশোধন এবং আমর বিল মা’রুফ ও নেহি আনিল মুনকারের নীতিমালার প্রয়োগ, ইসলামী আইন ও দন্ডের বিধান কার্যকরকরণ এবং জ্বিহাদ ফি সাবীলিল্লাহ প্রভৃতি হচ্ছে ঈমানদার প্রত্যেকটি মানুষের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি ভূখন্ডের প্রয়োজন। এটি পিতৃভূমি, মাতৃভূমি অথবা Place of domicile হতে পারে। এই ভূখন্ডের প্রতি ভালবাসা, তার বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল প্রকার সামরিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করা প্রত্যেকটি মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে দেশ প্রেম। এই দেশ প্রেমের ভিত্তি আল্লাহর মহববত, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অপরের প্রতি মহববত (হুববুন ফীল্লাহ), আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শরিয়া নির্ধারিত পন্থায় অপরের প্রতি শত্রুতা পোষণ (বুগদুন ফীল্লাহ), রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মহববত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শ্রেষ্ঠ জানা এবং উসওয়ায়ে হাসানা বলে মানা, ইখলাস বা আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা, আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা, সবর এবং আল্লাহভীরুতা। এখানে অন্ধ প্রেমের কোনও সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে সূরা আল আনয়ামের ১৬২ নং আয়াত প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে, ‘‘বলোঃ আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ শুধু আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য, তার কোনও শরীক নেই।’’
সূরা আল-বাকারার ১৬৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘মুমিনদের বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা আল্লাহকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভালবাসে। এই ভালবাসা এত প্রবল ও সুদৃঢ় যে অন্য কোনও ভালবাসা অথবা ভীতি তাদেরকে এক বিন্দুও টলাতে পারেনা।’’
কুরআন মাজীদে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সূরা আল মুজাদিলার ২২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘তুমি (মুহাম্মাদ) (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী লোকদের এমন কখনও দেখতে পাবেনা যে, আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতাকারীদের প্রতি তারা ভালবাসা পোষণ করে। যদিও (ঐ সব বিরোধিতাকারীরা) তাদের পিতা-মাতা হোক, সন্তানাদি হোক, ভাই বেরাদার হোক কিংবা বংশ পরিবারের লোক হোক। এরা সেই সমস্ত লোক যাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমানকে সুদৃঢ় করেছেন এবং নিজের তরফ থেকে একটা রুহ দান করে তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। ........ এরাই হচ্ছে আল্লাহর দলের লোক।’’ সূরা আলে ইমরানের ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা অপর মুমিন ছাড়া কাফিরদের কখনো পৃষ্ঠপোষক বানায় না।’’
সূরা আল হুজুরাতের ১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘প্রকৃত মুমিন তারাই যারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর আর সন্দেহে পড়ে না এবং নিজেদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে। এরাই (তাদের ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী।’’
সূরা আত্ তাওবার ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘মুমিন নারী ও পুরুষের আরো বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা পরস্পরের বন্ধু, সাহায্যকারী। তারা একে অপরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করে.......।’’
গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। এ প্রেক্ষিতে ইসলামী দেশপ্রেম কুরআন সুন্নাহর আদর্শকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, ভূখন্ডের পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ থাকে না। আল্লামা ইকবাল তার কবিতায় এরই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘চীন ওয়া আরব হামারা হিন্দুস্তাঁ হামারা, মুসলিম হ্যায় হাম ওয়াতন, সারা জাঁহা হামারা।’’ অবশ্য আধুনিককালে পরিচয়ের জন্য আদর্শ ভিত্তিক জাতীয়তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে এদেশের মুসলিমরা গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং তার ভিত্তিতে তাদের দেশপ্রেম পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে দেশপ্রেমঃ একটি পর্যালোচনা
দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি জনপদ হিসেবে বাংলাদেশ ভূখন্ডটি যুগযুগ ধরে সুপরিচিত হলেও মীর জাফরের ন্যায় বিশ্বাস ঘাতকের সংখ্যাও এই অঞ্চলে কখনো কম ছিলনা। ব্যক্তি স্বার্থে গোষ্ঠী ও জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার নজির এখানে প্রচুর রয়েছে। দেশপ্রেম এখানে জোয়ার ভাটার ন্যায় কখনো ভরা কাটাল কখনো মরা কাটালের রূপ ধারণ করেছে। মীর জাফর, জগৎশেঠ, উমি চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতার কাছে দেশপ্রেম পরাভূত হবার পর এই ভূখন্ডটি বৃটিশ বেনিয়া শক্তির কবলেই শুধু যায়নি বরং তাদের ভারত বর্ষ দখলের গেটওয়ে হিসেবেও কাজ করেছে। ফলে প্রায় পৌনে দু’শ বছর ধরে আমরা বৃটেনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোলামী করতে বাধ্য হই। দেশী বিশ্বাস ঘাতক ও বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তির শোষণ নির্যাতনের ধকল সামলিয়ে এদেশের দেশ প্রেমিক শক্তির মেরুদন্ড খাড়া করে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠনে প্রায় ১০০ বছর সময় লাগে এবং ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে তার অভিব্যক্তি ঘটে। কিন্তু আবারও শিখ এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠীর বিশ্বাস ঘাতকতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রযাত্রা রূদ্ধ হয়ে যায়। মঞ্জিলে পৌছাতে আরো ৯০ বছর সময় লাগে। এ পথেও বাধা আসে। এই বাধা ডিঙ্গিয়ে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে আমরা মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমি হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করি। বাংলাদেশ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত হয় এবং ১৯৭১ সালে নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর এই সময়টা ছিল তৎকালীন পূ্র্ব পাকিস্তানবাসীদের জন্য মহা সংকটকাল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রদেশব্যাপী যে অসহযোগ, হরতাল, অবরোধ, অগ্নি সংযোগ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং অবাঙ্গালী জনপদের উপর যে অত্যাচার-অবিচার শুরু হয়েছিল তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান আর্মীর নির্মম ক্র্যাকডাউন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে এনে দিয়েছিল অমানিশার অন্ধকার। তাদের জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও নিরাপত্তা ছিলনা। যখন তখন গ্রেফতার, পাশবিক ও দৈহিক অত্যাচার এবং নির্যাতন পরিণত হয়েছিল নিত্যদিনের ভাগ্য লিপি। এই সময়টি ছিল দেশ প্রেমিকদের পরীক্ষা দেয়ার প্রকৃষ্ট সময়। সীমান্তপারে ভারত ভূখন্ডে আশ্রয় প্রার্থী ৭৫.৫৬ লক্ষ শরণার্থী ব্যতীত বাকী ৭ কোটি বাঙ্গালী ছিল কার্যতঃ সশস্ত্র হিংস্র পাক বাহিনীর হাতে বন্দী। এরা পাক বাহিনীর জুলুম সহ্য করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আহার, আশ্রয় এবং অন্যান্য সহযোগিতা দিয়েছে। তারা আত্মত্যাগ করেছে, স্বজন হারিয়েছে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। ভারতপন্থী দলগুলো ছাড়া অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরা তাদের সাহস জুগিয়েছে; পাক বাহিনীর হাত থেকে তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। পক্ষান্তরে ভারতপন্থী দলগুলোর নেতা-নেত্রীরা দেশবাসীকে তোপের মুখে ঠেলে দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সাথে সে দেশে প্রাণ ভয়ে শরণার্থী হয়েছিল ৭৫.৫৬ লক্ষ লোক, সাম্প্রদায়িক বিভাজন অনুযায়ী যাদের মধ্যে ছিল ৬৯.৭১ লক্ষ হিন্দু, ৫.৪১ লক্ষ মুসলিম এবং ০.৪৪ লক্ষ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোক। প্রবীণ রাজনীতিবিদ জাতীয় লীগ প্রধান অলি আহাদের ভাষায়,
‘‘ভাগ্যের কি পরিহাস, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এদেশের মৃত্যুঞ্জয়ী সাত কোটি মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ভারতের আশ্রয় প্রার্থী শরণার্থীদের দৃষ্টিতে পাক বাহিনীর সহযোগী রূপে অভিযুক্ত হয় এবং এক পলকে পরিণত হয় এক অচ্ছ্যুত শ্রেণীতে। আরো পরিতাপের বিষয় ১৬ ডিসেম্বরের পরে অনুষ্ঠিত অত্যাচার, অবিচার, লুটপাট, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ-নির্যাতন ১৬ ডিসেম্বরের আগেকার মতই সমভাবে শহর নগর গ্রামের বাঙ্গালী জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে। ভারত প্রত্যাগত মুষ্টিমেয় শরণার্থী ছিল এর জন্য দায়ী।’’ দেশ প্রেমের দলীয়করণ এ ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলকে ভারসাম্যহীন করে তোলে এবং তারা সারা জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ এই দুটি শক্তিতে বিভক্ত করে নেয়। আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টার কমান্ডারকেও রাজাকারে পরিণত করে। দেশ প্রেম একটি বিশেষ দলের পৈত্রিক সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায়। কাগজে কলমে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পেলেও কার্যতঃ তা ভারতের বশংবদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভারতের মাটি থেকে ঢাকায় পদার্পন করেন ২০ শে ডিসেম্বর। বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীসহ তাদের কেউই পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। ভারতের আশ্রয় থেকে স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সরকার ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারী এক আদেশ বলে বাংলাদেশের মুদ্রামান ৬৬ শতাংশ হ্রাস করেন। পাশাপাশি একই তারিখ থেকে ভারতীয় ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক ঘোষণা করা হয় এবং দেশীয় পাটকলের স্বার্থে এতদিন পর্যন্ত ভারতের কাছে পাট বিক্রির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশ এবং ভারত পাট, চা, চামড়া বিক্রির ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের প্রতিযোগী ছিল। সরকারের উপরোক্ত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের পাট, চা ও চামড়া শিল্পে অন্ধকার নেমে আসে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের শতকরা ৯০ ভাগ ছিল কাঁচা পাট ও পাট জাত পণ্যের উপর নির্ভরশীল। পাটের বাজার উন্মুক্ত করে দেয়ায় এবং পাশাপাশি সীমান্ত খুলে দেয়ায় বৈধ ও অবৈধ উভয় পথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাট পাচার ও রফতানী মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ভারতের যে সমস্ত পাট কল ২০/২২ বছর ধরে বন্ধ ছিল কিংবা ক্যাপাসিটির এক চতুর্থাংশও উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছিল না সে পাট কলগুলো এতে পুনরায় পূর্ণ ক্যাপাসিটিতে চালু হয়ে যায়। পক্ষান্তরে শ্রমিক অসন্তোষ, কাঁচা মালের অভাব, গুদামে আগুন প্রভৃতি কারনে আমাদের পাট কলগুলো একের পর এক বন্ধ হতে থাকে এবং এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছে যে ভারতের সাথে প্রতিযোগিতার সামর্থ ও যোগ্যতা উভয়টাই আমরা হারিয়ে ফেলি। আমাদের রফতানী আরও সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পায়। ফলে খাদ্য-সামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্র আমদানীও কঠিন হয়ে যায়। ভারতীয় সিকিউরিটি প্রেস থেকে মুদ্রিত বাংলাদেশী নোটের সংখ্যা সরকার ঘোষিত সংখ্যা থেকে অনেক বেশি বলে প্রমাণিত হয় এবং এ প্রেক্ষিতে সরকার এই নোট অচল ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে এই সিদ্ধান্তের একটা অভিনব ও বিস্ময়কর দিক ছিল এই যে, সরকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরও ভারতে মুদ্রিত নোট বদলানোর সুযোগ দু’মাস পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হয়। এর অন্তনির্হিত তাৎপর্য সাধারণ মানুষের চোখেও ধরা পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রকট মুদ্রাস্ফীতির শিকারে পরিণত হয়। বাজারে এর অভিব্যক্তি ঘটে বিস্ময়করভাবে। কেনা কাটায় ভারতীয় মুদ্রার অবাধ প্রচলন শুরু হয়। ভারতীয় সৈন্য, ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং ভারতের সাধারণ নাগরিকরা বাংলাদেশের বাজার থেকে দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রীত বিদেশী পণ্য সামগ্রীসহ কয়েক শ’ কোটি টাকার দ্রব্য-সামগ্রী ক্রয় করে ভারতে নিয়ে যায়। এছাড়াও ভারতের মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কলকারখানা থেকে শত শত কোটি টাকার মেশিন পত্র ও যন্ত্রপাতির খুচরা অংশ, কাঁচামাল প্রভৃতি পাচার করে নিয়ে যায়। দুনিয়ার ইতিহাসে বহু রাষ্ট্র বৈদেশিক রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য-সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করেছে; কিন্তু কোনও রাষ্ট্র কর্তৃক তার কাগজী নোটের বিনিময়ে অর্থাৎ বিনামূল্যে সংঘবদ্ধ প্রতারণার মাধ্যমে লুটপাট করে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রকে এইভাবে নিঃস্ব করার নির্দয় নজির আর কোথাও নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারে যারা ছিলেন তারা এ দেশের মাটির সন্তানই ছিলেন, কিন্তু তারা এদেশে বেআইনীভাবে ভারতীয় কাগজী মুদ্রা প্রচলনে বাধা দেন নাই। দেশ বিক্রিতে তাদের বাধেনি। ৯৩০০০ যুদ্ধ বন্দী বাংলাদেশ থেকে সোনা দানা সহ যে দামী দ্রব্য-সামগ্রী লুট করে আত্মসাৎ করেছিল ভারতীয় সেনা বাহিনী তাদের কাছ থেকে সেগুলোও ছিনিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে এবং তাদের পরিবার পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানী সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর পরিত্যক্ত অস্ত্র-সস্ত্রও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে দেয়নি, ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় দৈনিক অমৃত বাজারে ১৯৭৪ সালের ১২ মে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত সরকার পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র-সস্ত্রের মধ্য থেকে দুই থেকে আড়াই শ’ রেলওয়ে ওয়াগন ভর্তি অস্ত্র-সস্ত্র ভারতে স্থানান্তরিত করেছে এবং এতে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি ছিল। এ ছাড়াও মহা চীন কর্তৃক নির্মিত জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী থেকে ভারতীয় সৈন্যরা শত শত কোটি টাকার অস্ত্র, নির্মাণ সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ভারতে নিয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চিনি কল, বস্ত্র কল ও পাট কলের যন্ত্রপাতি পাচার তো ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তৎকালীন সরকারের দৃষ্টিতে তারা হয়ে পড়েছিলেন দেশের শত্রু। এই প্রতিবাদের কারণে মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম সেক্টার কমান্ডার মেজর জলিলকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল।
বলা বাহুল্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারতে অবস্থানকালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতার বিনিময়ে ভারত সরকারের সাথে সাতটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তিগুলোর বিষয় বস্ত্ত ছিল নিম্নরূপঃ
1) ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হবে। গুরুত্বের দিক থেকে এবং অস্ত্র-শস্ত্র এবং সংখ্যায় এই বাহিনী মূল সামরিক বাহিনী থেকে বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ হবে (যেমন, রক্ষী বাহিনী)।
2) ভারত থেকে সমরোপকরণ এবং অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করতে হবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে তা করতে হবে।
3) ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে।
4) ভারতীয় পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
5) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির অনুরূপ হবে।
6) ভারতের সম্মতি ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত কোনও চুক্তি বাতিল করা যাবে না।
7) ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোনও সময় যে কোন সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে বাধাদানকারী শক্তিকে চুরমার করে দেয়ার অধিকার তার থাকবে।
উপরোক্ত চুক্তিগুলো প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই সাতটি চুক্তি ঈষৎ পরিমার্জিত রূপে ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সালা ’বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তি’ চুক্তিতে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দেশের সকল রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করেছিল। তৎকালীন সরকার দেশের স্বার্থের পরিপন্থী ও জাতিদ্রোহী অবস্থান থেকে এক চুলও নড়তে রাজী ছিলনা এবং চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে পার্লামেন্টের বা বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণেরও প্রয়োজন বোধ করেনি।
ভারতকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা চালুর অনুমতি প্রদান ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘৃণ্যতম কাজগুলোর অন্যতম। এই বাঁধ চালু করার ফলে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবার ঝুঁকিতে নিক্ষিপ্ত হয়। ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা ও তার অববাহিকা অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যায়, গাছ-পালার পুষ্টি উপাদানে সংকট দেখা দেয় এবং আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব বিপদ সীমা অতিক্রম করে। লোনা পানির প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায় এবং এর ফলে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নিউজপ্রিন্ট মিল খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিল সহ বাংলাদেশের হাজার হাজার শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। শীত মওসুমে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও গোদাগাড়ি পয়েন্টে এখন লঞ্চ, ষ্টীমারের পরিবর্তে গরুর গাড়ী চলে। নদী এখন চর। এছাড়াও ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব ইন্দিরার মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুযায়ী তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু তার পরিবর্তে তিন বিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের পাওনা ছিট মহলগুলোতে অদ্যাবধি আমাদের দখল ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিজ ভূখন্ড বিদেশের হাতে তুলে দেয়া, স্বাধীন একটি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার বিসর্জন ও তার আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দান দেশ প্রেমের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা তা অবশ্য পরীক্ষা সাপেক্ষ ব্যাপার।
সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগ দেশ প্রেমের দাবীদার একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের ছিনতাই, লুন্ঠন, পাচার, হত্যা, গুম ও ব্যভিচার দেশবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সরকারের ব্যর্থ প্রশাসনিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পলিসি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় অর্থনীতির যোগানদার অর্থনীতিতে পরিণত করে। পণ্য দ্রব্যের মূল্য ক্রেতা সাধারণের নাগালে বাইরে চলে যায়। ক্ষেত, খামার ও কলকারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়, কলকারখানা ও কাঁচা পাটের গুদামে শুরু হয় অগ্নিসংযোগ ও স্যাবোটেজ। সর্বত্র দেখা দেয় খাদ্য সামগ্রী ও পণ্য দ্রব্যের তীব্র অভাব। ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে দুর্ভিক্ষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে লক্ষ লক্ষ লোক। বিরোধী কন্ঠকে স্তব্দ করার লক্ষ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইন, জন নিরাপত্তা আইন প্রভৃতি প্রণয়ন ও নির্বিচার প্রয়োগ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার উচ্চ মার্গে পৌছে। কিন্তু তাতেও এই দলের ক্ষমতা লিপ্সা শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী সংযোজনের মাধ্যমে সারা দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামক একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। দু’টি সরকার দলীয় ও দু’টি সরকারী মালিকানাধীন পত্রিকা ছাড়া আর সকল দৈনিক পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা ও বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রবীণ রাজনীতিক অলি আহাদের ভাষায়, ‘‘ক্ষমতার লোভ, এক শ্রেণীর মেরুদন্ডহীন নেতা ও রাজনৈতিক কর্মী, নীতিহীন বুদ্ধিজীবি ও চরিত্রহীন টেন্ডলের যোগসাজশে বাংলার সর্বত্র নগরে, বন্দরে, কলকারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, ক্ষেতে খামারে দিল্লীর দাসেরা আওয়াজ তুলতে থাকে, এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’’
এখানে স্মরণ করা দরকার যে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্টের ঐতিহাসিক বিপ্লবের পূর্বে নোয়াখালীর রামগতির তোরাবগঞ্জে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছিল। এতে এর আরোহী দু’জন সিনিয়র ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। পরদিন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারযোগে এই দুই ভারতীয় কর্মকর্তার মৃতদেহ কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের আকাশ সীমা লংঘন করে প্রতিবেশী দেশের একটি সামরিক হেলিকপ্টারের এত অভ্যন্তরে এসে বিধ্বস্ত হবার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত রহস্যজনক। ভারতীয় দৈনিক আনন্দবাজার ও আজকাল বার বার সে দেশের সরকারের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েও কোনও উত্তর পায়নি। বাংলাদেশের তরফ থেকেও এ ঘটনার উপর কোনও মন্তব্য বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তবে কুটনৈতিক বাধা, সরকারী নিষেধাজ্ঞা এবং গোয়েন্দা বিধি-নিষেধ অতিক্রম করে যে গোপন তথ্যটি পরবর্তী কালে বেরিয়ে এসেছিল তাতে দেখা যায় যে, ঐ হেলিকপ্টারের আরোহীরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক দলিল বহন করছিলেন। এই দলিল অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে দিয়ে তাকে আগরতলা ভিত্তিক ভারতীয় বাহিনীর কম্যান্ডে ন্যস্ত করার প্রস্তাব ছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন সেনা প্রধান এই দলিলে স্বাক্ষর করার পর হেলিকপ্টার আরোহীরা আগরতলা কম্যান্ড এর কাছ থেকে প্রতিস্বাক্ষর করে কোলকাতা ফিরছিলেন বলে জানা যায়। ইতোমধ্যে ঢাকা সেনানিবাস ও বিমানবাহিনী হেড কোয়ার্টারের দেশ প্রেমিক কর্মকর্তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হন এবং দেশ এবং সেনাবাহিনীকে রক্ষার জন্য হেলিকপ্টারটি ভুপাতিত করে সমস্ত ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৫ আগষ্টের পট পরিবর্তন ঘটে। এতে দেশ ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে যেমন মুক্ত হয়েছিল তেমনি গণতন্ত্রও ফেরত পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা যে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল তারও অবসান ঘটেছিল। তখনকার দিনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মাহবুবুল আলম চাষী যথার্থই বলেছেন, ‘‘Many of the freedom fighters, who were once eager to sacrifice their lives for the cause of their motherland, were now trying to devour the entire nation. Excesses committed by them made normal work nearly impossible. Situation became so unmanageable that once a leader of a foreign delegation asked me whether the country was really liberated or it was conquered. I wanted to know why she asked this question. She told in reply that in a liberated country every body felt safe and happy, while in a conquered country, people were afraid and conquerers looted and plundered the conquered land. In her opinion the general condition in Bangladesh was closer to the latter.’’
অর্থাৎ ‘মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই যারা এক সময় মাতৃভূমির জন্য জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্ত্তত ছিল তারা এখন গোটা জাতিকে গিলে খাবার জন্য উদ্যত হয়ে পড়তে দেখা গেল, তাদের বাড়াবাড়ির ফলে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়লো, পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটলো যে, একবার বিদেশী এক প্রতিনিধি দলের নেতা আমাকে প্রশ্ন করেই বসলেন যে, এই দেশটি আসলে কি স্বাধীন করা হয়েছে না জয় করা হয়েছে। আমি তার এই প্রশ্নের কারণ জানতে চাইলাম, তিনি বললেন যে, স্বাধীন একটি দেশে প্রত্যেকটি লোক নিরাপদ থাকে এবং নিজেকে সুখীও পরিতৃপ্ত বোধ করে। পক্ষান্তরে বিজিত একটি দেশের মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে এবং বিজেতারা বিজিত দেশে লুটপাট চালায়। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থা শেষোক্ত দেশের অবস্থার খুবই কাছাকাছি।’ জনাব চাষীর এই উদ্বৃতি থেকে বিদেশীদের কাছে তৎকালীন বাংলাদেশের ইমেজ সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৮ জানুয়ারী বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপর বিএসএফ এর গোলক মজুমদার কর্তৃক ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব শ্রী রুস্তমজীকে লেখা এক গোপনীয় পত্রেও অনুরূপ একটি চিত্র পাওয়া যায়। এতে তিনি বলেছেন, ‘‘Conditions continue to be difficult in Bangladesh. Salt sells at Tk. 100.00 per seer while the cost of mustard oil is Tk. 250.00 per seer. The general public has become disgusted with corruption amongst high officials and politicians. Some sections have started openly questioning the competence of Sheikh Mujibur Rahman to administer the country. The opposition forces are trying hard to put up a strong front against the Awami League and armed clashes are not at all uncommon, specially in the country side. Quite a few police and army posts have been attacked and daring decoity have taken place in Dacca in broad day light. Students are becoming restive. There is a tendency to blame India for all ills of Bangladesh and in the process communal feelings are developing quite fast. Hindus are becoming more and more frustrated and there is a growing feeling amongst them that they are not wanted in Bangladesh .’’ রুস্তমজীকে লেখা গোলক মজুমদারের এটিই একমাত্র পত্র নয়, আরো অসংখ্য পত্রে তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেছিলেন যা কোন ক্রমেই সুখকর ছিলনা।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লংঘন, গণতন্ত্র হত্যা ও অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে জানমাল কুরবানী করেছে। তাদের রক্তের সাথে যারা বিশ্বাস ঘাতকতা করে দেশ শাসন করেছেন, লুটপাট, অত্যাচার নিপীড়ন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংসে পাকিস্তানীদেরও ছাড়িয়ে গেছেন তাদের দেশ প্রেমের স্কোর অবশ্য নির্ণিত হয়নি।
স্বাধীনতার হিফাজতঃ কিছু করণীয়
1) স্বাধীনতা অর্জনের তুলনায় স্বাধীনতার হেফাজত বা সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন একটি কাজ। এজন্য প্রয়োজন জাতির ইস্পাত কঠিন ঐক্য। সংকীর্ণ স্বার্থ, রাজনৈতিক ঈর্ষা-বিদ্বেষ, ক্ষমতার লোভ ও বিদেশী শক্তির আনুগত্য এবং দালালী এই ঐক্যের পথে বড় অন্তরায়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা ঐক্য বিনষ্ট করে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। ফিলিপাইনের জাতীয় বীর ডঃ রিজালের ভাষায় Why liberty if the slaves of today become the tyrants of tomorrow? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অত্যাচার, নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ক্ষমতাসীন দলের সীমাহীন দলীয়করণ, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহার জাতি প্রেম দেশাত্মবাবোধক কাজ নয়। এর ফলে জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভক্তি দেখা দেয়, পারস্পরিক আস্থাহীনতার জন্ম হয় এবং শত্রুরা উৎসাহিত হয়। দেশ রক্ষা এবং স্বাধীনতা হেফাজতের জন্য এই প্রবণতা রোধ করা অপরিহার্য।
2) ১৭৫৭ সালে মীর জাফর, জগৎশেঠ, উমি চাঁদের ন্যায় জনবিচ্ছিন্ন বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বার্থের বিনিময়ে বিদেশীদের কাছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিক্রির ফলে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয় এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষে পরাধীনতার অমানিশা নেমে আসে। এই স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে পৌনে দু’শ বছরের সংগ্রাম প্রয়োজন হয়েছিল। এই সংগ্রামে কোটি কোটি মানুষকে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। যারা বিশ্বাসঘাতক ও দালাল ছিল সংখ্যায় তারা ছিল হাতে গোনার মত। কিন্তু তাদের সংকীর্ণ স্বার্থের বলি যারা হয়েছিল তারা ছিল সংখ্যায় কোটি কোটি এবং বংশ পরম্পরায় প্রায় দু’শ বছর গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে মীর জাফররা মরে না, তারা Recycled হয়। তাদের ক্ষমতা লিপ্সা এবং ষড়যন্ত্রও অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য এদের মুখোশ উন্মেচনের শক্তিশালী ব্যবস্থা থাকা উচিত। এই ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা নিরাপদ থাকতে পারে না। জনসচেতনতা ও জনগনের সতর্কতাই এর নিশ্চয়তা দিতে পারে।
3) রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের পেছনে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির আদর্শিক স্বকীয়তাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই উপমহাদেশের হিন্দু এবং মুসলিম এই দু’টি জনগোষ্ঠি দু’টি স্বতন্ত্র সত্তা এবং আলাদা জাতি। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল এবং ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতেই গণভোটের মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট আসাম থেকে এবং পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়েছিল। জনগণের মৌলিক আকিদা বিশ্বাস তথা ইসলামী আদর্শই ছিল এক্ষেত্রে মূল চালিকা শক্তি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধ্বংস সাধন, প্রসাদ রাজনীতির ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, অবিচার এবং অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনা ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষকে সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পতাকার এই পরিবর্তন এবং নতুন এই দেশের সৃষ্টি দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করেনি বরং লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ নিয়ে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের মূল ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে দ্বিজাতিতত্তব তথা আদর্শিক স্বাতন্ত্রের বিষয়টি মুখ্য না থাকলে ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আদলে গঠিত আদর্শের ধারক বাহক হিসেবে তার থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকার কোনও যৌক্তিকতা নেই। একটি মহল ইসলামকে গৌণ বিষয়ে পরিণত করে এ দেশে ভারতীয় আদর্শ চাপিয়ে দিতে চায়। সংবিধান থেকে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস সম্পর্কিত ধারার অবলোপনের চেষ্টা এরই একটি অংশ। এই প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয়া যায়না। এ ব্যাপারে দেশের মানুষ যাতে অতন্ত্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করতে পারে তার জন্য দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে জনমত গঠনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
4) অরক্ষিত স্বাধীনতা দেশকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দেয়। আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও বিকাশ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের এই যুগে যদি ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ ভিত্তিক সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য উপযু্ক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে আদর্শকে বাচিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়। দেশের মানুষ বিশেষ করে যুব সমাজ যদি আদর্শ বিচ্যুত হয়ে পড়ে তাহলে দেশ টিকে থাকতে পারে না। বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত শক্তিশালী গণমাধ্যম বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সৃষ্টি করতে হবে এবং সেগুলো পরিচালনার জন্য আদর্শনিষ্ঠ জনবল তৈরী করতে হবে। এক্ষেত্রে উন্নত জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আহরণ এবং বুদ্ধি বৃত্তির কোনও বিকল্প নেই।
5) দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক যুদ্ধ বিদ্যার সর্বশেষ কৌশল এবং যথাসম্ভব সর্বোন্নত যুদ্ধ উপকরণে তাদের সমৃদ্ধকরণ ও সেগুলো ব্যবহারে উন্নতর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর অপরাপর সংস্থাগুলোকে অবশ্যই দলীয় প্রভাব এবং সংকীর্ণ রাজনীতির উর্ধে রেখে তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। সেনাবাহিনীর দলীয়করণ কিংবা তাদের উপর রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি তাদের বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং এর ফলে বিদেশী হামলা মুকাবিলা করা এবং স্বাধীনতার হেফাজত তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
স্বাধীনতার হেফাজতের জন্য উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা ছাড়াও সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করা এবং দেশাত্মবোধক কাজ কর্মকে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। এছাড়াও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, জাতীয় আদর্শ এবং প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের সুরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুসমূহে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকমত্য অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। পাশাপাশি সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়া বা কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিশেষ কোনও বহিঃশক্তির আধিপত্যের কাছে নতি স্বীকারের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিহার করাও জরুরী। এ ব্যাপারে দেশপ্রেমিক শক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে।
শেষ করার আগে স্যার ওয়াল্টার স্কটের একটি উদ্বৃতি দিতে চাই, তিনি বলেছেন, ‘‘স্বদেশ প্রেমিকের ধর্ম বীরের ধর্ম, ভীরুর ধর্ম নয়। হয়ত গৃহ লক্ষ্মীর আহবান তোমাকে মুহূর্তের জন্য বিমনা করবে। হয়ত পুরানো স্মৃতির মায়া তোমাকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু জীবনের প্রতি পদে যারা ভয়ে ভয়ে ছোট ছোট বিধি নিষেধের গন্ডিতে নিজেদের বেঁধে রেখে গুটি গুটি এগয়য়ে যায় তাদের মত তোমাকে অচেনা অজানায় অখ্যাতির বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে না। আগামী দিনের পৃথিবী তোমাকে জানাবে সত্যিকারের শ্রদ্ধার্ঘ, হে বিদ্রোহী বীর, এগিয়ে চল।’’


তথ্যপুঞ্জীঃ
১) Alasdair Maclntyre: Is Patriotism a Virtue, State University of New York Press, 1995.
২) Charles Blattberg: From Pluralist to Patriotic Politics, Oxford Unversity Press, 2000.
৩) Craig Calhun: Is it Time to be Post National, Cambridge University Press, 2004.
৪) George Orwell: Notes on Nationalism, Secker and Warberg, 1953.
৫) Paul Gomberg: Patriotism is Like Racism, Humanity Books, 2002.
৬) Daniel Bar-Tal and Ervin Stand, Partriotism, Wadsworth Publishing 1999.
৭) Weebies: Patriotism.
৮) Mike Wasdin: Blind Patriotism.
৯) Emma Goldman: What is Patriotism.
১০) Samuel Johnson: Patriotism, Oxford University Press, 1948.
১১) Al-Quran.
১২) Oli Ahad: জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫।
১৩) Mahbubul Alam Chashi: In Quest of Swanirvar, Bangladesh Swanirvar Society.
১৩) Ministry of Foreign Affairs, Government of India, Bangladesh Documents.
১৩) S. K. Dasgupta Midnight Massacre in Dacca.
১৩) UPLB Press, Works of Dr. Rizal.

 

---o---